Tuesday, December 23, 2014

কালিঘাটে বিরিঞ্চিবাবা

কালিঘাটের এক টালির ছাদওয়ালা বাড়িতে সেদিন বিরিঞ্চিবাবার সান্ধ্য সভা বসেছে। কর্ত্রী মহোদয়ার ইচ্ছে, বাবা তাঁর ভবিষ্যৎ বলে দিন।

কর্ত্রীঃ বাবা! আমার বড় সর্বনাশ হয়েছে বাবা। বড় দুঃসময় ঘনিয়ে এসেছে। ছবি আঁকায় মনে বসছে না, লিখতে বসলে এক লাইনও মাথায় আসছে না। আমার কি হবে বলে দিন বাবা।

বাবাঃ তোকে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে! দাঁড়া দাঁড়া মনে করতে দে (কর্ত্রীর হাত ধরে চোখ বন্ধ করলেন)। চোখ খুলে - হ্যাঁ মনে পড়েছে। খোলস বদলে জন্মেছিস তো তাই মনে করতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল আর কি। তা ভালো ভালো...পুরুষ জন্মে শিল্পবোধ তীব্র হলে পরের জন্মে নারীর দেহ ধারণ করাই স্বাভাবিক। তাও তো হয়ে গেল প্রায় দু হাজার বছর আগের কথা। তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল রোমে। তুই তখন রোমের সিংহাসনে বসেছিস। দোর্দন্ডপ্রতাপ  সম্রাট। এক হাতে একের পর এক বিদ্রোহ দমন করছিস, অন্য হাতে একের পর এক নিত্যি নতুন থিয়েটার উদ্বোধন করছিস, খেলাধুলোর উন্নতির জন্য ক্লাবগুলোকে হাত খুলে টাকা দিচ্ছিস, সে এক রমরমে রোম তখন। রাজ্য তো নয় যেন বারোমেসে কার্নিভ্যাল! সেই সময়ে তোর সাথে আমার দেখা। পেত্রনিয়াসের নাটক দেখতে গিয়ে। নাটকের শেষে তুই কত গল্প করলি, বললি রোমকে তুই সেরা শহর বানাতে চাস। আমি বলেছিলাম সে তুমি কর, কিন্তু শুধু নাটক নভেল করে তো আর দেশ চলবে না, রাজ্যপাটের দিকেও তোমায় সমান নজর দিতে হবে। তুই চোখ ছলছলিয়ে বলেছিলি, "এসব যে আমার একটুও ভালো লাগে না বাবা। রাজ্যপাট নেওয়ার আগে আমি বুঝিনি এত দায়িত্ব নিতে হবে। ভেবেছিলাম দিব্যি বেহালা বাজিয়ে, নেচে কুঁদে দিন কেটে যাবে।" উফ সেদিন সেকি কান্না তোর। শেষে আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললাম "ঠিক আছে ঠিক আছে, এখন চলো তো ছাদে, তোমার বেহালা শুনি একটু।" তুই শুনিয়েওছিলিস। খাসা হাত ছিল তোর। যেমন তালজ্ঞান যেমন সুরের মুর্ছনা। বাজাতে বাজাতে এমন মোহিত হয়ে গেছিলিস যে আমি তোকে না বলেই সেদিন চলে এসেছিলাম। সেই রাতেই আমার রোম ছাড়ার কথা। পরে অবশ্য শুনেছিলাম তুই যখন বেহালা বাজাচ্ছিলিস তখন কারা যেন শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু তোর শিল্পী মন, ওসব ছোটখাটো আগুনের আঁচ গায়ে মাখলে চলে? 

এবারে সব মনে পড়ে গেছে মা! তুই তো আমাদের নিরো রে, সেই সম্রাট নিরো। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না মা, তুই শিল্প চর্চা করে যা। ওই তোর ভবিষ্যৎ। ওতেই তোর পয়, ওতেই লক্ষ্মী। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সাধনা করে যা, দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কর্ত্রী: কিন্তু বাবা ওরা যে আমার পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে বাবা।

বাবা: জানি রে জানি সব জানি। এটুকুতে বিচলিত হলে তোর চলবে কেন! আমি জানি ওরা বলছে যে তুই সুদখোরের টাকায় ভাই ভাইপোকে মোচ্ছব করতে দিয়েছিস। ওরা জানে না ইতিহাসে তোর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে মা সারদার নাম জনমানসে ফিরিয়ে আনার জন্য। সারদা বড় ভালো মেয়ে ছিল রে! তুই রোজ সূর্যাস্তের আগে পরে রামকৃষ্ণের নাম জপ কর।

কর্ত্রী: তাতে কি হবে বাবা?

বাবা: ওরে পাগলী সেই তো সারদার গুরু রে। সে যদি তাকে ডেকে পাঠায় সারদা কি না গিয়ে থাকতে পারবে? সে তখন ঠিক তোকে ছেড়ে তার স্বামীর ঘরে উঠবে। এই তোর পরিত্রাণের একমাত্র রাস্তা। জপ কর জপ কর...

(চোখ বুজে - রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ...)

2 comments: