Thursday, December 31, 2015

শব্দকোষ

রোজ সকালে বাড়ির উঠোনে একটা নিচু পিঁড়িতে বসে বড় জেঠিমা কুলোয় করে চাল ঝাড়ত। চালের একটা পড়ত কুলো থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে আবার নেমে আসত ঝিপ ঝিপ শব্দের তালে তালে। চাল থেকে বেছে রাখা খুদকুঁড়ো জমা করে রাখা হত একটা পুরনো দালদার টিনে। জেঠু মুঠো ভরে সেগুলো ছন ছন করে রকে ছড়িয়ে দিতেই ঝটাপট হুম হুম বক বক বকম বকম শব্দ তুলে গোলা লোটন গেরোবাজের দল রান্নাঘরের টালির চাল থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে কংক্রিটে টুক টুক করে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে নিমেষে সাবড়ে দিত সব। মার্ফি রেডিওটা খড়বড় খড়বড় করে উঠে বলত 'বিবর্তনের পথে মানুষ'...। বাগানে দুটো ইঁটের ফাঁকে শুকনো ডালপাতা সাজিয়ে ফস করে দেশলাই জ্বেলে ঠাকুমা এক হাঁড়ি চানের জল চাপিয়ে বসে থাকত একটু দূরে। চটপটমড়মড় করে জ্বলে ওঠার খানিক পরেই এলুমিনিয়াম হাঁড়ির জল টগবগটগটব করে ফুটে উঠে উথলে গিয়ে ফ্যাঁসসস করে আগুন নিভিয়ে দিত। ছোটকাকা অ্যাল্লল্লল্লল্লল্ল গ্লল্লল্লল্ল গ্লাগগ্লাগগ্লাগ পুচুক করে সাড়া বাড়ি জানিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলত উঠোনের কলে। দাদুর খুরপি খুপ খুপ করে গাছের তলার মাটি আলগা করত। ঠুং করে জানান দিত মাটিতে মিশে থাকা ইঁটের টুকরোর খবর। উপুড় করে রাখা স্টীলের গ্লাসটা তুলে কুঁজোর গলার কাছটা ধরে নামিয়ে আনতেই বগবগবগবগ শব্দে জল বেরিয়ে এসে ভরিয়ে দিত গ্লাসের ফাঁদ। পাথরে নরুন ঘষার শব্দ ছিল। ছোট পেতলের হামানদিস্তায় পান ছাঁচার শব্দ ছিল। জাঁতিতে সুপুরি কাটার শব্দও...
যেসব শব্দেরা ছোটবেলা ঘিরে ছিল তাদের অনেকগুলোই আজ আর নেই।

নতুন শব্দেরা এক এক করে জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। শিলনোড়ার শব্দের বদলে মিক্সির শব্দ, খাতায় পেন ঘষার শব্দের বদলে কীবোর্ড টেপার শব্দ। গ্র্যান্ডফাদারের ঢং ঢং থেকে অজন্তা ঘড়ির টুংটাং। ক্রিরিরিং ক্রিরিরিং থেকে পলিফোনিক থেকে এমপিথ্রি। এই ঘুর্ণায়মান শব্দটানেলের ভেতর দিয়ে যতই এগিয়ে চলেছি পেছনে একের পর এক দরজার নিঃশব্দ বন্ধ হওয়া টের পেতে পেতে, মস্তিষ্কের ক্রমবর্ধমান ভার স্মৃতির পায়রাখোপে ঠুসে দিতে থাকে দৈনন্দিনতার সাদামাটা মূর্ছনা।

রাতের হুল্লোড়ঘোর কাটিয়ে নতুন বছরের সকালে চোখ খোলার আগেই পাশের বাড়ির ঝপাস জল ঢেলে খ্যাংরা কাঠির ঝাঁটার খর খর ছপাস খর খর ছপাস শুনলেই বুঝব, মাংসের ভেতরে লাব ডুব লাব ডুব ছন্দে বয়ে চলা রক্ত, ক্যালেন্ডারকে থোড়াই কেয়ার করে।

Monday, December 21, 2015

কৃষ্ণকলি? হাউ সিলি...

সেই কোন ছোটবেলায় কাকিমার তুতো ভাইয়ের ফর্সা ছেলে আমাকে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল 'তুই এত কালো কেন? রোজ সাবান মাখিস না? আমাকে দ্যাখ আমি রোজ সাবান মাখি তাই এত ফর্সা।' সেইদিন থেকে বলছি ফাদার মাদার গড প্রমিস, আমি রোজ গরমকালে দুবেলা আর শীতে একবেলা করে নিয়ম করে সাবান মেখে আসছি যদি রঙটা এখটু খোলতাই হয় সেই আশায়। তবে এই গরীবের আশায় সমস্ত সাবান কোম্পানিই এক এক করে ছাই দিয়েছে। সেই দুঃখে কখনো আমার ফর্সা টুকটুকে কাকিমার মেয়ে হয়ে যাব ভেবেছি, আপেল খেলে রাজীব গান্ধীর মতো গোলাপি গাল হবে, মায়ের এই গুল বেবাক হজম করে যখনই আপেল দিয়েছে তখনই খেয়ে নিয়েছি। কাঁচা হলুদ বাটা আর সর মেখে সঙ সেজে বসে থেকেছি ফি রোববার। খোদাতালার দেওয়া রঙ এমনই পাকা, যে কোনকিছুতেই বিন্দুমাত্র টসকায়নি।

তারপর একদিন ক্লাস ফাইভ নাগাদ একসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারলাম। কন্ট্যাক্ট লেন্স কাকে বলে জানলাম, তা দিয়ে যে চোখের মণির রঙ পাল্টে ফেলা যায় জানলাম, আর স্রেফ চোখের মণির রঙ পাল্টে ফেললেই উত্তম ছদ্মবেশ ধরা যায় তাও। সেইসঙ্গে জানলাম নায়িকার রঙও আমার গায়ের মতোই কালো হতে পারে (নায়িকা হবার দুঃসাধ্য সাধ অবশ্য তাতেও জাগেনি থ্যাঙ্কফুলি) আর এও জানলাম যে কটা চোখের কালো নায়িকাকে নিয়ে গান লেখা যেতে পারে ইয়ে কালি কালি আঁখে, ইয়ে গোরে গোরে গাল...

তারপর একে একে অনেক কিছু জানতে লাগলাম। নাওমি ক্যাম্পবেল চিনলাম, নয়নিকা চ্যাটার্জি চিনলাম, ছায়াসূর্য দেখলাম, কৃষ্ণকলি শুনলাম, আর প্রেমে পড়্রতে, চুমু খেতে, টিউবলাইটের ফ্যাটফ্যাটে আলোর নীচেও উদ্দাম হতে যে গায়ের রঙের বিশেষ ভূমিকা থাকে না, ক্রমে ক্রমে জেনে গেলাম এর সবটুকুই। তারপরে শুনলাম কবে নাকি কোন কবি কাকে বলেছিলেন তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা ইত্যাদি প্রভৃতি। সব মিলিয়ে কনফিডেন্সে হেব্বি তোল্লাই।

তারপর কৃষ্ণকলির বয়স বেড়েছে ঢের। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফ্যাশনজ্ঞান। কৃষ্ণকলির নায়ক ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসামের ব্র্যান্ড আম্বাস্যাডার হয়েছে।

আর কৃষ্ণকলি? ওমা! সে কই! সে তো আর নাই!!! তার গলা মুখ মেমসাহেবের মতো সাদা, গালে রাজীব গান্ধীর মতো গোলাপি আভা, ঠোঁট টকটকে লাল, আর তার আঁচল উড়ে উড়ে আকাশবাতাস ছেয়ে বিশ্বসংসারের সমস্ত কালো মেয়ের কনফিডেন্স নিয়ে গেন্ডুয়া খেলছে।

গেন্ডুয়া গেন্ডুয়া...উচ্চারণভেদে গেরুয়া গেরুয়া।

Monday, December 14, 2015

ঘোর কলি

তারপর সেদিন তো খিদেয় যাকে বলে পেট দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তাও আবার যেমন তেমন খিদে নয়। বাংলা মাংস-ভাতের খিদে। খুব স্পেসিফিক চাহিদা। এদিকে ঘড়িতে দুপুর বেজেছে; হাতের কাজটুকুও শেষ; ডিসেম্বরের টলটলে দুপুর আস্তে ধীরে গড়িয়ে নামছে। নিউ মার্কেটের দিক থেকে গ্লবের গলিতে ঢুকে বাঁয়ে ঘুরে, ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে পড়ে, রাস্তা টপকে, ফায়ার ব্রিগেড ক্রস করে, পরের মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই কস্তূরী। না না আসলে হিংলাজ। যোজন ক্রোশ মরুভূমি পেরিয়ে আসা তীর্থযাত্রির মতোই হুড়মুড়িয়ে দৌড় দিলাম দোতলার দিকে। বাইরের বেসিনে হাত ধুয়ে কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই একরাশ আমিষ গন্ধ এসে ডাইভ মারল নাকের ফুটো লক্ষ্য করে। একগাদা লোক তখন টেবিলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হাসিমুখের বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করল - "কজন?"
ডান তর্জনীখানা তুলে বুঝিয়ে দিলাম যে ন্যাকা হলেও আসলে আমি একা। ব্যস!
বেচারার বাদামের খোসারং মুখের মধ্যে সাদা চোখ দুটো গোল হয়ে উঠে ভুরু অবধি পৌঁছে আবার প্রশ্ন 'একা!?' আবার মাথাখানা সামনে পেছনে নাড়িয়ে জানালাম হ্যাঁ। অবশেষে সে ঘুরে গিয়ে একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। বুঝলাম, বেচারা জানেই না, মহিলারাও নিজে নিজে স্রেফ একা একা খেতে পারে কারুর সাহায্য না নিয়েই। বড় মায়া হলো। ঠিক করলাম বেচারাকে নিরাশ করব না।
ছোট স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বাটির একবাটি ঝাল ঝাল শুকনো শুকনো চিকেন ভরতা আর নৌকোর মতো স্টীলের বাটির একবাটি ঝোল ঝোল খাসির মাংস উইথ দামড়া আলু মেখে একথালা ফুলকো ফুলকো ভাত হুশ করে উড়িয়ে দিলাম। শেষের অংশটায় একটু গন্ধ লেবুর রস মেখে নিয়েছিলাম। তারপর চাটনি। কিন্তু আমের চাটনি না থাকায় সে প্ল্যান ক্যানসেল করে দিয়ে প্লেটে জরুরি অবতরণ ঘটিয়ে বসল একবাটি রসমালাই। মরে যাওয়া দুধের লালচে ক্ষীরের মধ্যে নরম তুলতুলে প্রায় ভালনারেবল দুখানা রসগোল্লা, যার এক টুকরো চামচে কেটে একটু ক্ষীর সমেত মুখে তুললেই ওই গোবর্ধন বেয়ারাকে পজ্জন্ত ক্ষমা করে ফেলা যায়।
সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে যতটা সম্ভব গন্ধ হাত থেকে দূর করার চেষ্টা করে বিফল হয়ে কাউন্টারে ফিরে এসে মিছরি দেওয়া মৌরি চিবুতে চিবুতে দুখানা টুথপিক পকেটস্থ করে, সেই আশ্চয্য কাজটা করে ফেললাম। ব্যাগ থেকে পারস বের করে পয়সা দিয়ে ফেললাম।

কী আশ্চয্যের ব্যপার বলুন তো! মেয়েমানুষ, নিজে হাতে করে একা একা ভালোমন্দ গিলে পকেট থেকে পয়সা বের করে দাম চুকিয়ে বেরিয়ে গেল! কোনও লোকাল গার্জেনের তত্ত্বাবধান ছাড়াই! এও হয়! ঘোর কলি...