Thursday, December 31, 2015

শব্দকোষ

রোজ সকালে বাড়ির উঠোনে একটা নিচু পিঁড়িতে বসে বড় জেঠিমা কুলোয় করে চাল ঝাড়ত। চালের একটা পড়ত কুলো থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে আবার নেমে আসত ঝিপ ঝিপ শব্দের তালে তালে। চাল থেকে বেছে রাখা খুদকুঁড়ো জমা করে রাখা হত একটা পুরনো দালদার টিনে। জেঠু মুঠো ভরে সেগুলো ছন ছন করে রকে ছড়িয়ে দিতেই ঝটাপট হুম হুম বক বক বকম বকম শব্দ তুলে গোলা লোটন গেরোবাজের দল রান্নাঘরের টালির চাল থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে কংক্রিটে টুক টুক করে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে নিমেষে সাবড়ে দিত সব। মার্ফি রেডিওটা খড়বড় খড়বড় করে উঠে বলত 'বিবর্তনের পথে মানুষ'...। বাগানে দুটো ইঁটের ফাঁকে শুকনো ডালপাতা সাজিয়ে ফস করে দেশলাই জ্বেলে ঠাকুমা এক হাঁড়ি চানের জল চাপিয়ে বসে থাকত একটু দূরে। চটপটমড়মড় করে জ্বলে ওঠার খানিক পরেই এলুমিনিয়াম হাঁড়ির জল টগবগটগটব করে ফুটে উঠে উথলে গিয়ে ফ্যাঁসসস করে আগুন নিভিয়ে দিত। ছোটকাকা অ্যাল্লল্লল্লল্লল্ল গ্লল্লল্লল্ল গ্লাগগ্লাগগ্লাগ পুচুক করে সাড়া বাড়ি জানিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলত উঠোনের কলে। দাদুর খুরপি খুপ খুপ করে গাছের তলার মাটি আলগা করত। ঠুং করে জানান দিত মাটিতে মিশে থাকা ইঁটের টুকরোর খবর। উপুড় করে রাখা স্টীলের গ্লাসটা তুলে কুঁজোর গলার কাছটা ধরে নামিয়ে আনতেই বগবগবগবগ শব্দে জল বেরিয়ে এসে ভরিয়ে দিত গ্লাসের ফাঁদ। পাথরে নরুন ঘষার শব্দ ছিল। ছোট পেতলের হামানদিস্তায় পান ছাঁচার শব্দ ছিল। জাঁতিতে সুপুরি কাটার শব্দও...
যেসব শব্দেরা ছোটবেলা ঘিরে ছিল তাদের অনেকগুলোই আজ আর নেই।

নতুন শব্দেরা এক এক করে জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। শিলনোড়ার শব্দের বদলে মিক্সির শব্দ, খাতায় পেন ঘষার শব্দের বদলে কীবোর্ড টেপার শব্দ। গ্র্যান্ডফাদারের ঢং ঢং থেকে অজন্তা ঘড়ির টুংটাং। ক্রিরিরিং ক্রিরিরিং থেকে পলিফোনিক থেকে এমপিথ্রি। এই ঘুর্ণায়মান শব্দটানেলের ভেতর দিয়ে যতই এগিয়ে চলেছি পেছনে একের পর এক দরজার নিঃশব্দ বন্ধ হওয়া টের পেতে পেতে, মস্তিষ্কের ক্রমবর্ধমান ভার স্মৃতির পায়রাখোপে ঠুসে দিতে থাকে দৈনন্দিনতার সাদামাটা মূর্ছনা।

রাতের হুল্লোড়ঘোর কাটিয়ে নতুন বছরের সকালে চোখ খোলার আগেই পাশের বাড়ির ঝপাস জল ঢেলে খ্যাংরা কাঠির ঝাঁটার খর খর ছপাস খর খর ছপাস শুনলেই বুঝব, মাংসের ভেতরে লাব ডুব লাব ডুব ছন্দে বয়ে চলা রক্ত, ক্যালেন্ডারকে থোড়াই কেয়ার করে।

Monday, December 21, 2015

কৃষ্ণকলি? হাউ সিলি...

সেই কোন ছোটবেলায় কাকিমার তুতো ভাইয়ের ফর্সা ছেলে আমাকে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল 'তুই এত কালো কেন? রোজ সাবান মাখিস না? আমাকে দ্যাখ আমি রোজ সাবান মাখি তাই এত ফর্সা।' সেইদিন থেকে বলছি ফাদার মাদার গড প্রমিস, আমি রোজ গরমকালে দুবেলা আর শীতে একবেলা করে নিয়ম করে সাবান মেখে আসছি যদি রঙটা এখটু খোলতাই হয় সেই আশায়। তবে এই গরীবের আশায় সমস্ত সাবান কোম্পানিই এক এক করে ছাই দিয়েছে। সেই দুঃখে কখনো আমার ফর্সা টুকটুকে কাকিমার মেয়ে হয়ে যাব ভেবেছি, আপেল খেলে রাজীব গান্ধীর মতো গোলাপি গাল হবে, মায়ের এই গুল বেবাক হজম করে যখনই আপেল দিয়েছে তখনই খেয়ে নিয়েছি। কাঁচা হলুদ বাটা আর সর মেখে সঙ সেজে বসে থেকেছি ফি রোববার। খোদাতালার দেওয়া রঙ এমনই পাকা, যে কোনকিছুতেই বিন্দুমাত্র টসকায়নি।

তারপর একদিন ক্লাস ফাইভ নাগাদ একসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারলাম। কন্ট্যাক্ট লেন্স কাকে বলে জানলাম, তা দিয়ে যে চোখের মণির রঙ পাল্টে ফেলা যায় জানলাম, আর স্রেফ চোখের মণির রঙ পাল্টে ফেললেই উত্তম ছদ্মবেশ ধরা যায় তাও। সেইসঙ্গে জানলাম নায়িকার রঙও আমার গায়ের মতোই কালো হতে পারে (নায়িকা হবার দুঃসাধ্য সাধ অবশ্য তাতেও জাগেনি থ্যাঙ্কফুলি) আর এও জানলাম যে কটা চোখের কালো নায়িকাকে নিয়ে গান লেখা যেতে পারে ইয়ে কালি কালি আঁখে, ইয়ে গোরে গোরে গাল...

তারপর একে একে অনেক কিছু জানতে লাগলাম। নাওমি ক্যাম্পবেল চিনলাম, নয়নিকা চ্যাটার্জি চিনলাম, ছায়াসূর্য দেখলাম, কৃষ্ণকলি শুনলাম, আর প্রেমে পড়্রতে, চুমু খেতে, টিউবলাইটের ফ্যাটফ্যাটে আলোর নীচেও উদ্দাম হতে যে গায়ের রঙের বিশেষ ভূমিকা থাকে না, ক্রমে ক্রমে জেনে গেলাম এর সবটুকুই। তারপরে শুনলাম কবে নাকি কোন কবি কাকে বলেছিলেন তন্বী শ্যামা শিখরি-দশনা ইত্যাদি প্রভৃতি। সব মিলিয়ে কনফিডেন্সে হেব্বি তোল্লাই।

তারপর কৃষ্ণকলির বয়স বেড়েছে ঢের। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফ্যাশনজ্ঞান। কৃষ্ণকলির নায়ক ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসামের ব্র্যান্ড আম্বাস্যাডার হয়েছে।

আর কৃষ্ণকলি? ওমা! সে কই! সে তো আর নাই!!! তার গলা মুখ মেমসাহেবের মতো সাদা, গালে রাজীব গান্ধীর মতো গোলাপি আভা, ঠোঁট টকটকে লাল, আর তার আঁচল উড়ে উড়ে আকাশবাতাস ছেয়ে বিশ্বসংসারের সমস্ত কালো মেয়ের কনফিডেন্স নিয়ে গেন্ডুয়া খেলছে।

গেন্ডুয়া গেন্ডুয়া...উচ্চারণভেদে গেরুয়া গেরুয়া।

Monday, December 14, 2015

ঘোর কলি

তারপর সেদিন তো খিদেয় যাকে বলে পেট দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তাও আবার যেমন তেমন খিদে নয়। বাংলা মাংস-ভাতের খিদে। খুব স্পেসিফিক চাহিদা। এদিকে ঘড়িতে দুপুর বেজেছে; হাতের কাজটুকুও শেষ; ডিসেম্বরের টলটলে দুপুর আস্তে ধীরে গড়িয়ে নামছে। নিউ মার্কেটের দিক থেকে গ্লবের গলিতে ঢুকে বাঁয়ে ঘুরে, ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে পড়ে, রাস্তা টপকে, ফায়ার ব্রিগেড ক্রস করে, পরের মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই কস্তূরী। না না আসলে হিংলাজ। যোজন ক্রোশ মরুভূমি পেরিয়ে আসা তীর্থযাত্রির মতোই হুড়মুড়িয়ে দৌড় দিলাম দোতলার দিকে। বাইরের বেসিনে হাত ধুয়ে কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই একরাশ আমিষ গন্ধ এসে ডাইভ মারল নাকের ফুটো লক্ষ্য করে। একগাদা লোক তখন টেবিলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হাসিমুখের বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করল - "কজন?"
ডান তর্জনীখানা তুলে বুঝিয়ে দিলাম যে ন্যাকা হলেও আসলে আমি একা। ব্যস!
বেচারার বাদামের খোসারং মুখের মধ্যে সাদা চোখ দুটো গোল হয়ে উঠে ভুরু অবধি পৌঁছে আবার প্রশ্ন 'একা!?' আবার মাথাখানা সামনে পেছনে নাড়িয়ে জানালাম হ্যাঁ। অবশেষে সে ঘুরে গিয়ে একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। বুঝলাম, বেচারা জানেই না, মহিলারাও নিজে নিজে স্রেফ একা একা খেতে পারে কারুর সাহায্য না নিয়েই। বড় মায়া হলো। ঠিক করলাম বেচারাকে নিরাশ করব না।
ছোট স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বাটির একবাটি ঝাল ঝাল শুকনো শুকনো চিকেন ভরতা আর নৌকোর মতো স্টীলের বাটির একবাটি ঝোল ঝোল খাসির মাংস উইথ দামড়া আলু মেখে একথালা ফুলকো ফুলকো ভাত হুশ করে উড়িয়ে দিলাম। শেষের অংশটায় একটু গন্ধ লেবুর রস মেখে নিয়েছিলাম। তারপর চাটনি। কিন্তু আমের চাটনি না থাকায় সে প্ল্যান ক্যানসেল করে দিয়ে প্লেটে জরুরি অবতরণ ঘটিয়ে বসল একবাটি রসমালাই। মরে যাওয়া দুধের লালচে ক্ষীরের মধ্যে নরম তুলতুলে প্রায় ভালনারেবল দুখানা রসগোল্লা, যার এক টুকরো চামচে কেটে একটু ক্ষীর সমেত মুখে তুললেই ওই গোবর্ধন বেয়ারাকে পজ্জন্ত ক্ষমা করে ফেলা যায়।
সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে যতটা সম্ভব গন্ধ হাত থেকে দূর করার চেষ্টা করে বিফল হয়ে কাউন্টারে ফিরে এসে মিছরি দেওয়া মৌরি চিবুতে চিবুতে দুখানা টুথপিক পকেটস্থ করে, সেই আশ্চয্য কাজটা করে ফেললাম। ব্যাগ থেকে পারস বের করে পয়সা দিয়ে ফেললাম।

কী আশ্চয্যের ব্যপার বলুন তো! মেয়েমানুষ, নিজে হাতে করে একা একা ভালোমন্দ গিলে পকেট থেকে পয়সা বের করে দাম চুকিয়ে বেরিয়ে গেল! কোনও লোকাল গার্জেনের তত্ত্বাবধান ছাড়াই! এও হয়! ঘোর কলি...

Thursday, November 26, 2015

স্ত্রী-বুদ্ধি ভয়ঙ্করী

রবীন্দ্রনাথ, লেনিন, বাবা-মা আর নারীর যৌনাঙ্গ নেই। মানে আছে, কিন্তু থাকতে নেই। মানে থাকতে আছে, কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করা চলে না। এঁদের যৌনজীবন, পছন্দ অপছন্দ, অভ্যেস, চয়েস কোনকিছু নিয়েই না। এর মধ্য়ে আবার মহিলাদের ব্যপারটা আরেক ধাপ এগিয়ে। কোনভাবে যদি এমন খবর পাওয়া যায় যে অমুক মহিলা তমুক লোকটার সঙ্গে থাকবে বলে নিজের বর-কে ছেড়ে চলে এসেছে, সংস্কারী জনতা তার শাপশাপান্ত বাপবাপান্ত করে সোশ্যাল মিডিয়া নামক চন্ডিমন্ডপে একে অপরের গা টিপে, চোখ মেরে রসালো জোক ছড়িয়ে দিয়ে বলবে - উফফ কী জিনিস! ওর খিদে মেটানো কি আর অমুকের কম্ম রে?

তার ওপর যদি দেখা যায় সেই মহিলা দু পয়সা কামিয়েছে এবং তালেবর হনুদের কম্যান্ড করে বেড়াচ্ছে জ্বলুনি আরও বেড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় শোনা যেতে থাকে - আরে এইসব মহিলাদের চিনতে কারুর বাকি নেই। নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে যার তার বিছানা গরম করতে এদের বিবেকে বাধে না।

বিবেক মানুষটা আবার খুব ফ্লেক্সিবল। কখনো বাবল গামের মতোন ফুলে ওঠে আবার কখনো লাথ খাওয়া কেন্নোর মতো কুঁকড়ে গর্তে সেঁধোয়। সুনন্দা পুষ্কর রহস্যজনকভাবে মারা যাবার পর বিবেক বোধকরি জুড়িগাড়ি চেপে হাওয়া খেতে বেরোয়। যে বিবেক 'দেখেছ কান্ড! নষ্ট মেয়েছেলেটা শশি থারুরের মতো সুপাত্রকে পাকড়েছে? নাহয় কটা বিয়েই করেছে। তাতে কী? হীরের আংটি আবার বেঁকা! তাছাড়া পুরুষমানুষের অমন একটু আধটু দোষ থাকেই। আহা কী সুন্দর ইংরিজি বলে, কেমন ফর্সা রং...আহা! ওই মেয়ছেলের আছে টা কী?' বলে হাঁক পেড়েছিল, সে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়।

ইন্দ্রাণী মুখুজ্জ্যের বিছানার রোল কল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দেশভক্ত জনতা ভুলে যায়, সংবিধান বলেছে, বিচারাধীন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ -  innocent until proven guilty। আসলে অপরাধ নিয়ে তো তাদের মাথাব্যথা নেই। অপরাধী শনাক্ত হওয়া কিম্বা শাস্তি পাওয়ার ব্যপারটাও গৌণ। প্রাণভরে স্লাট শেমিং করা গেলে আর কী চাই? তাই, ইন্দ্রাণীর স্বামী গ্রেফতার হবার পর তারা বলেই ফেলে 'বাবা কী মেয়ে দেখেছ! সকলকে নাচিয়ে ছেড়েছে।'

এ কথা মানুষমাত্রেই জানে, যে স্ত্রী-বুদ্ধি ভয়ঙ্করী। স্ত্রী'র কথা শুনে চলে যে পুরুষ তাকে বলা হয় স্ত্রৈণ। স্বামীর কথা শুনে চলা/অনুগত স্ত্রী-এর জন্য অবশ্য এমন কোনও শব্দ অভিধানে নেই। কারণ স্পষ্ট। স্ত্রী স্বামীর কথা শুনবে এতে আবার অস্বাভাবিক কী আছে? এমনটাই তো হওয়ার কথা! তাও যদি চুপিচুপি ঘরের দোর দিয়ে বৌ-এর কথা শোনো মেনে নেওয়া যায়। প্রকাশ্যে স্ত্রী-এর উল্লেখমাত্র করলেও বাজারে জল্পনা শুরু হয়ে যায়, রাতে ওদের পছন্দের পজিশন নির্ঘাত ওম্যান অন টপ।

আমির খান মহাশয়ের বক্তব্যের পরেও আরেকবার তাই হলো। কিরণ রাও দেশে 'সেফ' বোধ না করলে যে দেশের অনেকানেক বীরপুঙ্গব তাঁকে সেই 'সেফটি' দিতে ইচ্ছুক এমন শোনা যায়। আমিরের চেয়ে কম বয়সী সঙ্গি বেছে নিতে পারলে নাকি তাঁর এমনটা মনে হতো না, কারণ এ কথা আমরা সকলেই জানি যে স্বামীর কাজই হলো স্ত্রী'র রক্ষাকর্তা হওয়া। যেখানে সানি লিওনির মতো গরম গণ-ভোগ্যা মহিলা এদেশে 'সেফ' কিরণ রাও-এর মতো 'সাধারণ' চেহারার মহিলা এদেশে কেন নিশ্চিন্ত বোধ করছেন না সেই নিয়েও প্রশ্ন শুনি। কিরণের ছোট চুল, ছোট বুক যে এদেশে কোনও পুং বিশ্বামিত্রকে টলাতে পারবে না, বুঝতে পারি।

শুধু মাঝেসাঝে, খুউউউউব মাঝেসাঝে (যেমন গত মাসে হলো দিল্লীতে) কিছু পুরুষের হাতে দুই-পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ের ধর্ষণের খবর পড়ার সুযোগ পাই। ওদের একঢাল চুল, বিভঙ্গের ঢেউ, সুডৌল বুক, এসব ছিল?

Wednesday, July 15, 2015

বাহুবলে বাজিমাত

বাহুবলির টিকিট মূল্য হিসেবে আইনক্স ২৯০/- টাকা লুটে নিল। পুঁজিবাদকে গালমন্দ করতে করতে হলে ঢুকলাম এবং ঢুকেই বুঝলাম, আসলে আইনক্সের  বদলে সি এস লিউইস-এর নারনিয়ার সেই আলমারিতে ঢুকে পড়েছি যার ওপারের পৃথিবীতে গাছ-পাথর-জন্তু-অর্ধমানব-সিংহ কথা বলে, যুদ্ধ করে, রাজ্যশাসন করে।  প্রায় তিনঘন্টার  লম্বা সিনেমায়  বিভিন্ন সময়ে নিজের হাতে  চিমটি কেটে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে, মাছি ঢুকে যাবার মতো বড় হাঁ করে বসে থেকে  জানতে পারলাম গল্প শেষ হইয়াও শেষ হইল না। কারণ বাকিটা ব্রেক কে বাদ - ২০১৬ এ রিলিজ। অগত্যা হিসেব কষতে বসলুম।


  • ভায়াগ্রা জলপ্রপাত (নায়াগ্রার বাবা) - ১০০/- টাকা 
  • নায়কের প্রপাতারোহণ পতন ও পুনরায় আরোহণ- ৪০/- টাকা
  • ফর্সা টুকটুকে পেলব কাঁচুলি পরিহিতা নায়িকা - ৩০/- টাকা
  • ঝরনার আনাচেকানাচে উড়ন্ত প্রেমগান - ১৫/- টাকা
  • ট্রপিক্যাল জঙ্গল - ৭.৫০/- টাকা
  • গ্লেসিয়ার - ৭.৫০/- টাকা
  • বরফ ধস - ১০/- টাকা 
  • টোবোগ্যাগিং করে বরফ ধস কাটানো - ৫/- টাকা 
  • সি জি আই শহর - ২৫/- টাকা 
  • যুদ্ধ - ৩৫/- টাকা 
  • কাগজের তৈরি নকল হাত - ৫/- টাকা 
  • মানুষ বনাম সি জি আই ষাঁড়ের চোখধাঁধানো লড়াই - ১০/- টাকা 


willing suspension of disbelief - PRICELESS



Monday, June 29, 2015

আমেরিকার গর্ব আমার নয়

আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রগতিশীল দেশ, এমন ধারণা উপমহাদেশের কেউ কেউ সানন্দে পোষণ করেন। অথচ আমেরিকা সেই দেশ যাদের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের পরে ভোট দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে কেটে গেছে এতগুলো দশক। মহিলা রাষ্ট্রপতি তারা স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও নির্বাচন করতে পারেনি। আমেরিকা এমন একটা দেশ যেখানে মৃত্যুদণ্ড স্বমহিমায় বহাল। আমেরিকা সেই দেশ যেখানে সংসদে (কংগ্রেস) মহিলা সদস্য ১৮% মাত্র। সর্বশেষে, আমেরিকা পৃথিবীর তেইশতম দেশ যেখানে সমকামী বিয়েকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হলো। এর আগে আরো বাইশটা দেশ এই পদক্ষেপ নিয়েছে, আমেরিকাকে এই বিষয়ে পথিকৃত কোনমতেই বলা চলে না।

অথচ কী আশ্চর্য, ফেসবুকের রামধনু রঙের জোয়ার দেখলে মনে হচ্ছে আমেরিকা সমকামী বিয়ের স্বীকৃতি দেওয়ামাত্র পৃথিবীর সমস্ত সমকামী/এলজিবিটি মানুষের স্বাধিকারপ্রাপ্তি ঘটে গেছে। ফেসবুকের সেলিব্রেট প্রাইড অ্যাপটি আমাদের শেখাচ্ছে আমেরিকার গর্বে গর্ব করে কিভাবে প্রোফাইলের ছবিটা রামধনু রঙে ঢেকে ফেললেই প্রমাণ হবে আমি সমকামীদের সমব্যথি/সহমর্মী। কিভাবে আমেরিকার সমকামীদের সাথে একাত্মবোধ করতে না পারলে আমার আলোকপ্রাপ্তি অসম্পূর্ণ থাকবে। আমেরিকা যেন পৃথিবীর প্রতীক, আমেরিকার সাফল্যেই জগতের সাফল্য। গ্লোবাল সিটিজেন হয়ে উঠবার প্রথম ও সর্বপ্রয়োজনীয় ধাপ, আমেরিকার সাথে একাত্মবোধ করা।

রাষ্ট্রপতি ওবামাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারার জন্য। মার্ক জুকারবার্গকে অভিনন্দন নিজের দেশের আইনব্যবস্থা/সরকারের গর্বে ছাতি ফুলিয়ে ফেসবুকময় রামধনু রং ছড়ানোর জন্য। তবে এ প্রশ্ন না করে থাকা যাচ্ছে না, যদি সসাগরা পৃথিবীর সমকামীদের অধিকারের ব্যপারে ফেসবুক এতটাই সচেতন, তাহলে আয়ারল্যান্ডের মতো দেশ (যেখানে এখনও ভ্রুণহত্যা নিষিদ্ধ) সমকামীদের সমানাধিকারের স্বীকৃতি দিলে কেন তা নিয়ে কাউকে উচ্চবাচ্য তো দূর, মাথা ঘামাতেও দেখা যায় না!

গোটা ব্যপারটা আর তাতে উপমহাদেশের অত্যুৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান বলার পর এবার বলা হবে আমেরিকার গর্ব আমাদের গর্ব।

Thursday, June 25, 2015

রজঃস্বলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি...

অতঃপর পৃথিবী রজঃস্বলা হইলেন। মন্দিরদ্বার রুদ্ধ হইল। বিধবার অন্নব্যঞ্জন নিষিদ্ধ হইল। হলকর্ষণ মুলতুবি রইল। তথাপি একটি গূঢ় সমস্যার কোনরূপ সমাধান করিতে না পারিয়া ধর্মগুরুরা সভার আয়োজন করিয়া পরামর্শ করা স্থির করিলেন। সকল গুরুদ্বিগের প্রস্তাব শ্রবণ করিয়া মহাগুরু (ডান্স বাংলা ডান্সের সহিত ওঁর কোনও যোগাযোগ নাই) সিদ্ধান্তে উপনীত হইবেন, এমন প্রস্তাব লওয়া হইল। মহাগুরুর নাম জানিতে আমাদের কিয়ৎকাল প্রতিক্ষা করিতে হইবে।
সভাস্থলে গুরুরা সকলে একে একে নিজ নিজ প্রস্তাব রাখিতে লাগিলেন।
রক্ষী মহারাজ - ইহযাবতকাল ধরিয়া শুনিয়া মানিয়া ও বলিয়া আসিয়াছি, রজঃস্বলা নারি অশুচি, অপবিত্র। তাহাকে স্পর্শ করা অনৈতিক, অশুদ্ধ কর্ম হিসাবে চিহ্নিত হইবে। তথাপি, পৃথিবীর রজঃকালে আমরা কোন বিচারে ইহার পৃষ্ঠে কাল অতিবাহিত করিব? আমার প্রস্তাব, অম্বুবাচী চলাকালীন আমরা প্রত্যেকে বৃক্ষপৃষ্ঠে কাল অতিবাহিত করি। ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় ফলাহারের উপকরণ সাথে লইয়াই যাইব।
নবীন ধোকারিয়া - মহাগুরুদেব, ইয়ে অপরাধ নেবেন না। আমার স্যার সারা গায়ে বাত, এই বয়সে গাছে চড়তে গিয়ে প্রাণপাখিটি উড়ে গেলে অনেক সাধ আহ্লাদ অপূর্ণ থেকে যাবে। তার ওপর বৃষ্টি বাদল গরম এসব আজকাল আর সহ্য হয় না। আমি বরং আমার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লিমোতে থাকি? পৃথিবীর মাটিতে পাও দিতে হলো না, আবার পিঠও বাঁচল।
সাধ্বী কাঁচি - গুরুদেব, পৃথিবী, ধরিত্রী, আমাদের মাতা। মাতা কখনও অশুচি হতে পারে না গুরুদেব! মাতাকে অশুচি করে একদল বিধর্মী, বেজাতের মানুষ। আমার প্রস্তাব, এই রজোঃপর্বে, সকল বিধর্মীকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হোক। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
ঘষারাম বাপু - ধরিত্রীর অশুচিতা লইয়া পুরুষদিগের কোনরূপ সমস্যা দেখিতেছি না। ধরিত্রীর রজোপর্বে সকল পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন মহিলার দেহে গমন করিলেই তাহারা অশুচিতা হইতে মুক্ত পাইবে এবং পুরুষদেহের ঈপ্সা পূর্ণ করিবার পুণ্যে উক্ত মহিলাগণও কোনরূপে কলুষিত হইবেন না।
এক্ষণে মহাগুরুদেব 'স্বামী চড়েন গদি' আপনার আসন হইতে পশ্চাদ্দেশ বিচ্ছিন্ন করিয়া দুই হস্ত সম্মুখে প্রসারিত করিলেন। সকল সভাসদগণ নিজ নিজ স্থানে দন্ডায়মান হইলে তিনি স্মিতহাস্য করিয়া বলিলেন, 'মিত্রোঁ, কতিপয় দিবস পূর্বে যে আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের আয়োজন করাইলাম, তাহার হেতু তোমাদের হৃদয়ঙ্গম হয়নি দেখিতেছি। পাঁজি দেখিয়া বুঝিয়া শুনিয়াই তাহা করিয়াছিলাম। যোগাভ্যাসে আমরা জাতিগতভাবে বিশেষরূপে পটু। অতএব, অম্বুবাচীর পঞ্চ দিবস, যোগবলে ভূমিপৃষ্ঠ স্পর্শ না করিয়াই, শূন্যে ভাসমান হইয়া কাল অতিবাহিত করিব।  উক্ত স্টান্টের নামকরণ করিব - আসন শূন্য।

Wednesday, June 3, 2015

সূর্য বলল ইশ


সূর্যবাবুর বয়স হয়েছে। নিজেই বেশ বুঝতে পারছেন, এ ব্রহ্মাণ্ডে আর বেশিদিন নেই। অচিরেই একদিন ভুস করে নিভে যেতে হবে। আর তাই নেভার আগে দপদপিয়ে জ্বলে উঠেছেন। পাড়াময় তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছেন। এর পুকুর শুকিয়ে দিচ্ছেন, ওর মাথা টলিয়ে দিচ্ছেন, ঘামে ঘামাচিতে একসা করে ছেড়ে দিচ্ছেন পাহাড়  জঙ্গল সমতল। এমন দিন এসেছে যে পাহাড়ও হাসি ভুলে কাঁচুমাচু মুখে চেয়ে আছে নীচের সবুজ দাবদাহের দিকে।

এদিকে এদ্দিন যারা অজান্তে সুর্যবাবুকে সাহায্য করে এসেছেন ফ্রিজ এসি চালিয়ে ওজোন স্তর ফুটো করে, তারা পড়েছেন মহা ফাঁপরে। উঁচু বাড়ির উঁচু ট্যাঙ্কের জল কল দিয়ে বেরনোমাত্রই হাতে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। ওই জলে আলু ডিম সেদ্ধ করা কিম্বা ঠাকুমার হাঁটুতে সেঁক দেওয়া গেলেও, চান করার রিস্ক নেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফ্যান্সি ঝাঁ চকচকে বাথরুমে সবেধন নীলমণি বালতিখানা ঝি ঘর মোছার কাজে ব্যবহার করে।  বালতি ফালতির মতো আনফ্যাশনেবল ব্যপার স্যপার  গিন্নীমা মোটেই পছন্দ করেন না, কাজেই বালতিতে জল ভরে চারঘন্টা পরে চান করার সম্ভাবনাও নেই। অগত্যা প্রায় কাকভোরে আজানের সময়ে উঠে চান সেরে নটার মধ্যে শীত এবং আতপ নিয়ন্ত্রিত আপিসে ঢুকে পড়াই একমত্র উপায়। উইকেন্ডেও গেম প্ল্যানের বিশেষ পরিবর্তন হচ্ছে না। সক্কাল সক্কাল সপরিবারে একটা মলে ঢুকে পড়তে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে ভূমিকম্প যেকোনো বিষয়ের সিনেমা দেখে ফেলতে হবে। তারপর পান ভোজন এবং শেষে মলত্যাগ।

 অনেকেই এর মধ্যে কর্পোরেট চক্রান্ত দেখতে পাচ্ছেন। সূর্যবাবু এসি, কালো চশমা, কুলার কোম্পানির টাকা খেয়েই এমন কার্যকলাপ করছেন এমন অভিযোগ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে। এদিকে মানুষের ক্ষোভ জমতে জমতে আকাশ ছুঁয়েছে। তবে আকাশ ছুঁলেও সূর্যের নাগাল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ফেসবুক নামক বিপ্লবের প্ল্যাটফর্মে 'বদলা নয় বাদল চাই' আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য একটা অনলাইন পিটিশন জমা দেওয়া। অংশগ্রহণ করতে গেলে সুর্যকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফোরগ্রাউন্ডে নিজের ঘর্মাক্ত কলেবরের সেলফি তুলে পোস্ট করতে হচ্ছে। গোড়ায় অনেকে নিয়মাবলী খুঁটিয়ে না পড়ার কারণে জিম, বেডরুম ইত্যাদি নানা জায়গায় পরিশ্রমের ফলে ঘেমে যাওয়ার পর সেই ছবি তুলে পোস্ট করার ফলে আন্দোলনের হোতাদের লজ্জায় পড়তে হয়। বেশ কিছু ছবি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যানও করে। জনরোষ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শহরের একটি ওয়ার্ডে রক্তদান শিবিরে 'ভারতবর্ষ সুর্যের এক নাম' গান চালানোয় স্থানীয় লোকজন চড়াও হয়ে মাইক ভেঙে দেয়।   

সূর্যবাবুর মোটা চামড়ায় অবশ্য হেলদোলের লেশমাত্র নেই। নিজের উঁচু হাতির দাঁতের মিনারে রিমোট হাতে বসে অন্যান্য সৌরজগতের কর্তাব্যক্তিদের চালচলনের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সূর্যদা জানেন, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আর যতদিন তেজ, ঠিক ততদিনই ফুটেজ।

Sunday, May 17, 2015

ছাদ

গ্রীষ্মের রাতের এই এক মজা। এক একটা হাওয়ার ঢেউ আসে, আর চারপাশের সুপুরি নারকোল গাছের পাতারা সরসর ঝরঝর খরখর শব্দে দলে দুলে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। ঢেউ চলে গেলে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে পরের ঢেউটার জন্য। কিন্তু লোহার সিঁড়ির রেলিং ধরে বেয়ে ওঠা বিলিতি ফুলের গাছের সেসব উত্তেজনার বালাই নেই। পায়ের তলায় অল্প মাটি। ওর রেলিং ধরে বাঁচা। তাই নির্লিপ্তি প্র্যাকটিস করছে। ঝড় বাদল কালবোশেখি শিলাবৃষ্টি দখিনা বাতাস সবেতেই তিরতির তিরিতির করে কাঁপে। সে কাঁপুনিতে উল্লাসও নেই, উত্তেজনাও নেই, উন্মাদনাও নেই। শুধু নিজের বাঁচটুকুতে কনসেন্ট্রেট করেছে। আর আমি রাতে ছাদের লোহার সিঁড়িতে বসে হাওয়া খাই। কয়েকধাপ নীচে সিমেন্টের মেঝেতে, আলসেয় বসে সাইকাস, বেল, জবা, গোলাপ, নয়নতারা, ফার্ন, লিলি, লাল ফুলওয়ালা ক্যাকটাসের ছোট, বড়, মাঝারি, চ্যাপ্টা, লম্বাটে, গোলাকার মাটির টব, চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘুমোয়, মাঝে উসখুস করে, থম মেরে ঘাড় গুঁজে হাইওয়ের ধুলোর মতো জমতে দেয় গায়ে অন্ধকার চিরে ছড়িয়ে পড়া উঁচু বাতিস্থম্ভের জোরালো সাদা আলো। দূরে দূরের কোনো ছাদে সিগারেটের লাল আগুন কমছে বাড়ছে, ঘোরাফেরা করছে স্মার্টফোনের আলো। কথা বলার, আগুন ছোঁয়ার বেয়াড়া অভ্যেসে রাত জাগছে পায়চারীর ছাদ।

হয়ে গেল চশমা



সঃ আজ বাজার খুব খারাপ।

অঃ কত গেল?

সঃ হাজার দেড়েক।

অঃ ও মেকআপ হয়ে যাবে। খেয়াল রাখিস লস যেন পাঁচ হাজার না ছাড়ায়।

যঃ কাল ছোট মাসি ফোন করেছিল। ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ওর বিয়েতে কিন্তু ভালো কিছু দিতে হবে মনে রেখো। আমাদের মাইক্রোওয়েভ দিয়েছিল। অন্তত হাজার পাঁচেক বাজেট ধরে রাখো। আমিও কিছু দেব, চিন্তা কোরো না।

লঃ হুম।

যঃ কী হল?

লঃ কই কিছু না তো। শুনলাম।

যঃ ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই ওমনি শুনে নিলে? কী করো বলত সারাক্ষণ? কার সাথে এত কথা বলো? আমি কি কিছুই বুঝি না ভাবো?

লঃ যাহ বাবা! চোখ দিয়ে তো শুনি না। কান দিয়ে শুনি। যা বললে শুনে নিয়েছি। তোমার ছোট মাসির ছেলের বিয়ে। গিফটের বাজেট পাঁচ। শান্তি?

গঃ হ্যালো। কেমন আছিস?

ফঃ এই তো চলছে, বল।

গঃ শোন না, একটা দরকারে ফোন করলাম। মাইক্রোওয়েভে ভাপা ইলিশ করতে হলে কতক্ষণ সময় দেওয়া উচিৎ রে?

ফঃ পাঁচ মিনিট।

কঃ এই তোমার পাঁচ মিনিট? সবসময় এত ঢপ দাও কেন বলো দেখি? মোবাইল ফোনে কথা বলা মানেই ঢপ? এই নাকি তুমি অটো থেকে নামছ?

পঃ আরে! সত্যিই। লাস্ট মোমেন্টে সিগনাল খেয়ে গেলাম। নইলে পাঁচ মিনিটই লাগত। মাইরি বলছি। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।

কঃ আমার গা ছোঁয়ার জন্য আজকাল তোমাকে এসব ভুলভাল বাহানা দিতে হচ্ছে বুঝি?

রঃ একজন কাউকে ছুঁয়ে থাকতে হবে।

টঃ একটা ঠান্ডা দেহ, কে ছুঁয়ে থাকল কি থাকল না তাতে আর কার কিই বা যায় আসে বলত? শেষ তো সেই আগুন, সেই গঙ্গায়। এসব ফুল ধূপ আতরেরই বা কী দরকার!

রঃ আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। পা টা ছুঁয়ে বসে থাক শুধু। আর কাকিমাকে বলিস একটু লোহা, নিমপাতা, আগুন আর মিষ্টির আয়োজন করে রাখতে। শ্মশানযাত্রীরা ফিরলে লাগবে।

শ্মশানযাত্রীরা সদলবলে একটা মানুষকে আগুনের দিকে ঠেলে দেবে বলে মহাসমারোহে কাঁধে তুলে নেয়, হরিবোল দিতে দিতে, খৈ আর খুচরো পয়সা ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে চলে, গাড়িঘোড়া লোকজন তাদের সসম্ভ্রমে রাস্তা করে দেয়, কেউ কেউ কপালে হাত ছোঁয়ায়, আর কেউ মৃতদেহ দেখবে না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় চট করে। ঘাটের পুরোহিত ডোম, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। শ্মশানের এক কোণে একটা ঝুপড়ির সামনে এক বিহারি দম্পতি একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বসে আছে সকাল থেকে। গঙ্গায় চান করে ভিজে কাপড়ে বসে আছে ওরা। খালি পেটে। পাগলা বাবার আদেশে। ওই একটা মড়া এলো।

র: ওই বুড়োটা কী করে রে?

জ: শুনেছি মৃগী টিগি সারিয়ে দেয়। মন্ত্রপূত লিট্টি খাইয়ে। সবাই পাগলা বাবা বলে ডাকে।

র: সব শালা ভন্ড।

চঃ সব পাখি মাছ খায় আর নাম হয় আমার! বাড়িতে নিজের ঘরে বসে লুকিয়ে বিলিতি মারলে কোনো উচ্চবাচ্য নেই কারুর, আর আমি সপ্তাহে একদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলেই বাওয়াল? ধুসসালা ভাল্লাগে না...।

ষঃ ওরা বাড়িতে বসে খায়। রাস্তায় রিক্সাওয়ালার সাথে খুচরো নিয়ে বচসা করে পাড়া মাথায় করে লঙ্কাকান্ড বাধায় না।  

খঃ লক্ষ্মী মেয়ে উঠে এসো। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর টর বাধালে একটা কান্ড হবে। ফাল্গুন মাস!

হঃ (গান) একে তো ফাগুন মাস দারুণ এ সময়, লেগেছে বিষম চোট কী জানি কী হয়…

ছঃ আমি তোমার কাছে, সময় ছাড়া আর কিচ্ছু কোনদিন চাইব না।

ঘঃ হ্যাঁ বরাবরই তোমার দামী জিনিসের দিকেই নজর, জানি।

ভ: একটা ক্রিমের দাম আটশো টাকা! এত দামী ক্রিম হয়!

শ: এটা এন্টি এজিং ক্রিম। এগুলো একটু দামিই হয়। তুমি এসবের কী বোঝো শুনি? আর তোমার টাকায় তো কিনিনি। তোমার এত মাথাব্যথা কীসের?

ড: নিজের টাকায় তো কিনেছ? কষ্ট করে উপার্জন করা টাকায়। এভাবে নষ্ট করার কোনো মানে হয়?

শ: আর তুমি যে তোমার কষ্ট করে উপার্জন করা দিনের পর দিন ইনভেস্ট করার নামে নষ্ট করছ তার বেলা? কোনদিন তো লাভ করেছ বলে শুনলাম না।

ড: ওটা আর এটা এক?

শ: হ্যাঁ। ওটাও বাজার। এটাও। তুমিও খদ্দের, আমিও।   

Wednesday, April 1, 2015

দীপিকা, ক্লিভেজ এবং তাঁর choice

দীপিকা পাডুকোনকে আমার দারুণ লাগে। কী মিষ্টি দেখতে। কী লম্বা। কী সুন্দর গালে টোল পড়া হাসি। অভিনয়ও নেহাৎ মন্দ নয়। তবে এ কথাও সত্যি, ওঁর অভিনয়ের চেয়ে রূপের আমি বেশি ভক্ত। তাই, ফ্যাশন ব্লগে দীপিকার appearance দেখব বলে মুখিয়ে থাকি। সিনেমার প্রোমশনে, পার্টিতে, এয়ারপোর্টে দীপিকা কী পোষাক পরলেন, কিরকম মেক আপ করলেন, কী কী গয়না পরলেন এসব দেখতে, মাপতে, ফলো করতে বেশ লাগে।

কয়েকমাস আগে দীপিকাকে ঘিরে একটা বিতর্ক হয়। বলা ভালো, দীপিকার ক্লিভেজ ঘিরে। কোনও এক আন্তর্জালিক পেজ থ্রি ওয়েবসাইট দীপিকার ক্লিভেজের ছবি দেখিয়ে একটি ছবি প্রকাশ করে যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শকের দৃষ্টি তাঁর ক্লিভেজের দিকে আকর্ষণ করার। এবং সেই নিয়ে দীপিকা ভয়ানক অপমানিত বোধ করে সেই মর্মে কিছু বক্তব্য রাখেন। এখানে দুটো কথা বলার আছে -

১। দীপিকার মতন কৃশকায়া মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, তাঁদের স্তন এবং নিতম্ব ঠিক ভারতীয় পুরুষের পছন্দমাফিক হয় না। কিন্তু দীপিকা যেহেতু নায়িকা, এবং তাঁর সৌন্দর্য্যের মূল কনসিউমার পুরুষ, তিনি নানাবিধ enhancement pad এর সাহায্যে নিজের দেহ আরও রমণীয় করে তোলার চেষ্টা করেন এবং বলা বাহুল্য, সফলও হন। অর্থাৎ, পুরুষতন্ত্রের সৌন্দর্য্যের ব্যাখ্যা মেনেই সাধ্যমত সাজিয়ে তোলেন নিজেকে।

২। এই বিতর্কটা ঠিক তাঁর ছবি ফাইন্ডিং ফ্যানি রিলিজ করার আগেই হয়।

অন্যান্য নানা ফ্যাশন ব্লগ, পেজ থ্রি সাইটে দীপিকার পা, তাঁর বিভঙ্গ ইত্যাদির উল্লেখ করে বহু ছবি বহুবার দেখা গেছে এবং এখনও যায় যেগুলো নিয়ে তাঁকে বিশেষ মাথা ঘামাতে শুনি না।

এবারে আসা যাক vogue পত্রিকার তৈরি It's my choice ভিডিওটার কথায়। এই ভিডিও তে দীপিকা বলেছেন নারীর অধিকারের কথা। ইচ্ছেমতো যৌন সংসর্গ করার স্বাধীনতার কথা, যখন ইচ্ছে বাড়ি ফেরার স্বাধীনতার কথা, বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কে লিপ্ত হবার স্বাধীনতার কথা, ইচ্ছেমতো পোষাক পরার স্বাধীনতার কথা, ইত্যাদি। যেগুলো বলেননি, সেগুলো হলো কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের স্বাধীনতার কথা, যেমন ইচ্ছে জীবিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার কথা, হাউসওয়াইফ হয়েও স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকারের কথা, মেয়ে হয়েও পড়াশোনা করার অধিকারের কথা, ইত্যাদি।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ভিডিও রিলিজের সময়ও কাকতালীয় গুণে তাঁর আরেক ছবি 'পিকু' রিলিজের সময়ের সঙ্গে মিলে গেছে।  আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো vogue এমন একটি পত্রিকা যারা মাসের পর মাস তাদের প্রচ্ছদে পুতুলের মতো মডেলদের সাজিয়ে, ফটোশপের সাহায্যে ইচ্ছেমতো সেই মডেলদের রোগা এবং ফর্সা করে তাঁদের 'গ্রহণযোগ্য' করে তুলে বাজারে প্রকাশ করে।

এখন প্রশ্ন হলো, বলিউডের নামী অভিনেত্রী, যিনি প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে পুরুষ দর্শকের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছেন (by choice), তাঁর মুখের এ হেন নারীবাদী বুলি আমরা ঠিক কতটা সিরিয়াসলি নেব? নাকি অপেক্ষা করব সেই দিনের, যেদিন দীপিকা তাঁর দৈহিক প্রোপর্শনের তোয়াক্কা না করে, মেকআপের তোয়াক্কা না করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন এক রক্তমাংসের নারী হয়ে।



Tuesday, March 24, 2015

ইন্দ্রিয়সুখ

সারি সারি হলুদ ম্যাগির চেন ঝোলানো মনোহারি দোকান, বনেট খুলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো খৈনি টেপা ট্যাক্সিওয়ালা, পান বিড়ির গুমটি, গলির জটলা চোখের পাশ দিয়ে সরে সরে যায়। উত্তম-সুচিত্রার বাইকগানের প্রেক্ষাপটের মতন। সিগনালপোস্ট রাগি চোখ লাল করে পথ আটকায় একদল হলুদ সবুজ অটোর। রাস্তা পেরতে দেয় না।

হঠাৎ হাওয়ার দমকে উড়ে যায় কবির মিউজের বুকের আঁচল। জল ছেটানো রজনীগন্ধা, এগরোল চাটুর পোড়া তেল, গেরস্তের কালোজিরে ফোড়ন, সর পড়া ফুটন্ত দুধ, বেনারসি জর্দার উগ্র গন্ধ এসে লাগে নাকে।

দূরের মিটিং এর মাইক জবাব চায় সরকারের কাছে। কন্ডাকটর শুনিয়ে দিয়ে যায় খালি সীটের হদিশ। উলোঝুলো পাগল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে থাকে দুই তিন চার অক্ষরের অভিযোগ। ব্যস্তবাগীশ অটোর হর্ন ছুটে এসে ঢুকে পড়ে কানের গর্তে। ছুঁড়ে ফেলা এঁটো ভাঁড় আছড়ে পড়ে খং করে ভেঙ্গে ছিটকে গিয়ে লাগে নেড়ি কুকুরের পেছনের পায়ে। চমকে কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে ওঠে পাড়ার ভুলু। হকারের এফএমে মাখনগলায় হেমন্ত বলে ওঠে 'সুন যা দিলকি দাস্তাঁ'।

ঘেমে পিঠের চামড়ায় লেপ্টে যাওয়া জামায় হাওয়া লাগে। মুহুর্তে শিরশিরানি নামে শিরদাঁড়া বেয়ে। কাঁটা ফুটে ওঠে সারা গায়ে। কিছুক্ষণ আগেই উপুড় করা কালো কফির তিতকুটে পরত ছড়িয়ে জড়িয়ে থাকা জিভ ঠোঁট চেটে খুঁজে পায় লিপস্টিকের চেনা স্বাদ।

একটা গোটা শহর রক পাখীর মতো উড়ে এসে প্রকান্ড ডানায় ঢেকে ফেলে শরীরের শিরা, উপশিরা, দাগ, খাঁজ, ভাঁজ ঢেউ। অযথা আদর করে।



Wednesday, March 18, 2015

মুখ এবং বুক

বহু বছর হল মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেছে। এবার বুক ঢাকার পালা। উঁহু এ বুক সে বুক নয়। এ হল book। ফেসবুক নামের যে তরঙ্গে ভেসে আমরা নিরন্তর ছুঁয়ে চলেছি ভিনদেশের, ভিনবাড়ির, ভিনজগতের জীবন তাদের ভাগ করে নেওয়া ছবির, স্ট্যাটাসের, লেখার মাধ্যমে; চ্যাট বাক্সে যাদের বলছি রাতের মেনু, কলেজের কেচ্ছা অথবা আগ্রহভরে শুনছি বিয়ে ভাঙ্গার গল্প - একদিন হঠাৎ ঠিক করলাম, এসবের থেকে বিরতি নেওয়ার দরকার। আর ভদ্রমহিলার যেহেতু এক কথা, তাই কয়েকটা ক্লিক পরপর করে, অ্যাকাউন্টখানা deactivate করে দেওয়া গেল। মেইলের বাক্সে, এসএমএস-এ কয়েকটা প্রশ্ন ছুটে এল আমার কী হয়েছে জানতে। খুচরো বৈরাগ্য শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরেও গেল।

আসলে সত্যি যদি তেমন বলার মত কিছু হতো, মানে বেশ মুখরোচক কিছু - যেমন ধরুন হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে কেউ রেপ করল, অথবা অ্যাসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিল চাঁদমুখ, অথবা কুপিয়ে খুন করে গেল, অথবা লিম্ফোসারকোমা অফ দ্য ইন্টেস্টাইনের প্রকোপে বেঘোরে প্রাণ গেল, তাহলে কিন্তু আয়েশ করে বাড়িতে বসে মাউস টিপে টিপে deactivate করে উঠতে পারতাম না প্রোফাইলখানা। উল্টে আমার অবর্তমানে সেখানা আমার স্মৃতিসৌধ হয়ে জ্বলজ্বল করত আন্তর্জাল প্রান্তরে। রাশি রাশি ছবি, লেখা, লোকদেখানো আদিখ্যেতা পড়ে থাকত একা - লোকজন মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে যেত, কমেন্ট পড়ে পড়ে বুঝে নিতে চাইত প্রেম অপ্রেম বিষাদ আহ্লাদের হদিশ। হয়তো ভাবত আহা কেমন চ্যাট আলো করে থাকত গো, কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল...চুক চুক! হয়তো ভাবত না। টাইমলাইনে এসে হয়তো লিখে যেত তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, তোমার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি, সব ঝড় কেটে যায় একদিন...এও যাবে। হয়তো যেত না। হয়তো সুর্যোদয়ের, মেঘের, গোলাপের ছবিতে ছয়লাপ করে দিত, বা দিত না।

এদিকে কবি সেই কবেই অভিযোগ করে গেছেন - শরীর শরীর তোমার মন নাই? অথচ আমাদের দেখুন, শরীরের নাগাল পাই না, ছবিকেই শরীর বানাই, মনের নাগাল না পেয়ে স্মাইলি জমাই। মুখে বুকে আঙুল বোলাতেই চালাক ফোনের থেকে একরাশ রঙিন ধোঁয়া বেরিয়ে এসে গড়ে তোলে অবয়ব। বিজন ঘরে নিশীথ রাতে সকলেই ঢুকে পড়ি শূন্য হাতে।


Monday, March 9, 2015

আপনার হিরো ওয়ার্শিপের প্রয়োজন মেটানোর দায় নির্ভয়ার নয়

রোজ একই বিষয় নিয়ে লিখতে ভালো লাগে না। কিন্তু তাও মাঝেমাঝে বাধ্য হই। আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে এনডিটিভি খুলে দেখলাম একটা প্রদীপ জ্বলছে, তার পাশে ফুলের মালা, লেখা রয়েছে India's Daughter- হিসেব মতো এ দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল আসার কথা। আবেগে গলা বুঁজে আসার কথা। নির্ভয়া তোমাকে আমরা ভুলছি না ভুলব না গোছের স্লোগান তোলার কথা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এর কোনটাই হলো না। ছবিটা দেখে প্রথমেই মনে পড়ল দিল্লির অমর জওয়ান জ্যোতির কথা। যেকোনো শহীদকে আমরা এভাবেই মনে রাখি। কিন্তু, নির্ভয়া কি শহীদ? শহীদের অহংকার কি সে চেয়েছিল?

যে মেয়েটা আমাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বেঘোরে প্রাণ দিল, তাকে আমরা শহীদ বানালাম কোন মুখে? তার মৃত্যুর দায় তো আমাদের প্রত্যেকের। আমরা যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নারী শরীর পুরুষের ভোগের বস্তু এই মনোভাব কে প্রশ্রয় দিই, যারা prevention is better than cure থিওরি মেনে নিজেকে একটু বেশি ঢাকি, যারা অধস্তন মহিলা কর্মচারীকে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে অফিসে আসতে বারণ করি, তাদের সকলের। নির্ভয়া আমাদের লজ্জা। আমাদের ব্যর্থতার মুখ। সঙ্কির্ণতার মুখ। পৈশাচিকতার মুখ। তাকে শহীদ বানিয়ে ফেললেই কি সেই দায় নেমে যাবে কাঁধ থেকে?

নির্ভয়াকে আমাদের একজন victim  হিসেবেই মনে রাখতে হবে। শহীদের গৌরবের মোড়কে তাকে ঢাকলে কি আর এই লজ্জা ঢাকা যাবে? মুকেশের শাস্তি অথবা সংশোধন, তথ্যচিত্র ব্যান করার যৌক্তিকতা, ফাঁসী কাম্য না যাবজ্জীবন, এসব বিতর্কে নাহয় নাই বা গেলাম।

শুধু বলব, একজন বেতনভুক সরকারি যোদ্ধার সঙ্গে নির্ভয়াকে গুলিয়ে ফেলবেন না। আপনার হিরো ওয়ার্শিপের প্রয়োজন মেটানোর দায় নির্ভয়ার নয়। নির্ভয়া আমাদের লজ্জা। প্রশাসনের, সমাজব্যবস্থার, রাষ্ট্রের, শিক্ষাব্যবস্থার,  আমার, আপনার।

Monday, March 2, 2015

কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!


আমার নাম নির্ভয়া নয়। সৌভাগ্যবশত, আমাকে কেউ কোনদিন রেপ করেনি। যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে মেরে ফেলেনি। আমার অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে ধর্নাও দেয়নি। শুধু একটু আধটু গায়ে হাত টাত দিয়েছে রাস্তাঘাটে। তবে সেসব তো জলভাত। কবি তো আগেই বলে দিয়েছেন, আপনা মাংসেই হরিণা বৈরি হবার কথা। বানভাসি কন্যার জীবনভোর সর্বনাশ হবার কথা। ঐসব বলে তাই খামোকা আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। বরং 'সভ্য বদ্র পোষাক' পরে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে চড়াই শ্রেয়। তাছাড়া আজকে নির্ভয়ার কথাই বলা দরকার। কারণ আর কিছুই নয়, নির্ভয়া কান্ডে শাস্তিপ্রাপ্ত জনৈক যুবক সদ্য তার অসহায়তার কথা এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে। তার প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জেগে উঠেছে। 

সত্যিই তো। কোনও ভদ্র মেয়ে কি রাত নটায় এক পুরুষ বন্ধু সাথে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? নাকি ধর্ষিত হবে বুঝতে পেরে সেই কাজে বাধা দেয়? নাকি অভব্য পোষাক পরে বাড়ি থেকে বেরোয়? মেয়েরা যখন জানেই, তাদের শরীর পুরুষের ভোগবিলাসের উপাদান, সেইমতো চলাই তাদের উচিৎ। অযথা সাঁকো নাড়ালে যা হবার তাই হয়। দু পায়ের ফাঁকে হামলে পড়ে পৌরুষের বজ্রনির্ঘোষ। খোয়া যায় মান, সম্মান, প্রাণ। প্রাণ গেলে অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই, কারণ তাহলে আর ভগ্ন সম্মানের বোঝা বয়ে বাকি জীবনটা বেড়াতে হয় না। উলটে শহীদের মর্যাদা জোটে কপালে। মোমবাতি মিছিলও। আর উপরি পাওনা হিসেবে কখনো আত্মীয়স্বজনের চাকরি, আর্থিক অনুদান (ক্ষতিপূরণও বলতে পারেন) ইত্যাদি। এক কথায়, সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস যাকে বলে। আর এইসব সাত পাঁচ ভেবেই নির্ভয়ারা জিন্স টপ পরে, রাত করে বাড়ি ফেরে, পুরুষবন্ধুর সাথে খোলামেলাভাবে মেশে। শুধুমাত্র ধর্ষিত হবার আশায়। 

আর তাই আমরা, আমরা যারা রেপড হইনি বা করিনি বলে যথাক্রমে প্রিভিলেজড ও এনলাইটেন্ড, তারা নির্ভয়ার দোষীদের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই সোশ্যাল মিডিয়ায়। মৃত্যুদন্ডের মতো পৈশাচিক আইনের নিন্দা করতে। আর যে বেচারা লোকটা শুধুমাত্র এক মহিলার শরীর ভোগ করতে চেয়ে তার কাছে বাধা পেয়ে তাকে নির্যাতন করতে বাধ্য হয়, সে বিদেশী চ্যানেলকে বলে, "মহিলারাই ধর্ষনের জন্য বেশি দায়ী পুরুষদের চেয়ে।" 



নির্ভয়া আর অভিজিৎ রায়ের ভাগ্য একই গোত্রের। এই ভদ্রলোককেও সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছিল কোনো এককালে। নইলে কি আর সে যেচে পড়ে ধর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে মারা পড়ল? সে দায়ও কিন্তু তাকেই নিতে হবে। কারণ, যে বা যারা তাকে কুপিয়ে মারার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছে তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা, মানসিক গঠন, তারা সংখ্যালঘু না গুরু, ইত্যাদির চুলচেরা বিচার করাই সর্বাগ্রে কাম্য। নিন্দা করা কিম্বা শাস্তির দাবী, গৌণ। আহা খুনি বলে কি মানুষ নয়! তাদের কি শখ আহ্লাদ স্পর্শকাতরতা থাকতে নেই?  মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লে হুলের বিষ সহ্য করতে জানতেই হবে। 

বাড়ির বাইরে পা ফেলার আগে বা কলম ধরার আগে এ কথা মাথায় রাখতেই হবে, যে কোনো বিসদৃশ ঘটনার জন্য, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। 

Sunday, February 15, 2015

বসন্তের বর্ণমালা

তাহলে মিত্রোঁ বসন্ত সেই এসেই গেল। কিচ্ছু করার নেই!

অ - অভিমান
আ -  আস্কারা
ই - ইশশ!
ঈ - ঈর্ষা
উ - উচাটন
ঊ - ঊষ্মা
ঋ - ঋণশোধ
এ - একলা
ঐ - ঐসব
ও - ওলটপালট
ঔ - ঔষধহীন

ক - কোকিল
খ - খুনসুটি
গ - গ্যাদগ্যাদে
ঘ - ঘাইহরিণী
ঙ - কাঙাল
চ - চিমটি
ছ - ছুপা রুস্তম
জ - জবরদস্তি
ঝ - ঝকমারি
ঞ - জয় গোঁসাঞ
ত - তুলকালাম
থ - থামতে নেই
দ - দেখা হোক
ধ - ধ্যাৎ
ন - ন্যাকা!
ট - টেনশন
ঠ - ঠেকে শিখি না
ণ - মরণ
প - পারি না!
ফ - ফালতু লোক
ব - বয়ে গেছে
ভ - ভাগ্যিস
ম - মনকেমন
য - যাচ্ছেতাই
র - রয়েসয়ে
ল - লজ্জা পাস
ব - বলতে নেই
শ - শিকার
ষ - ষোড়শী
স - সহে না যাতনা
হ - হাত ধরাধরি
ড় - এক চড় দেব (বাজে কথা বললে)
ঢ় - মূঢ়
ং - ধ্বংসাত্মক
ঃ - যাঃ
ঁ - চাঁদ

Wednesday, February 4, 2015

মহিলাদের জন্য বইমেলা ভ্রমণের কিছু সহজ tips

১. পোষাক এবং জুতো যাই পরুন, মোজা পরতে ভুলবেন না নইলে পেডিকিয়োরের মামাসিমানুষ হয়ে যাবে
২. চুল্লুর পাউচ ছিঁড়ে খাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে একটা জলের বোতল ব্যাগে রাখুন
৩. লাইন দেওয়া প্র‍্যাকটিস করুন - টয়লেট, আনন্দ পাবলিশার্স, খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়াতে হলে এই বিদ্যা জানা জরুরি
৪. আপনার আলমারিতে জমতে থাকা অজস্র চট/কাপড়ের বিগশপারগুলোর মধ্যে যেকোনো একটা ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিন। কাজে লাগতে পারে
৫. আপনার পরিচিত সমস্ত লেখক (লেখিকা নয়) এর প্রকাশকের স্টলের সামনে গিয়ে হাজির হোন এবং মিষ্টি হেসে লেখকের সই করা এক কপি কম্পলিমেন্টারি বই ব্যাগগত করুন। খেয়াল রাখবেন, এই কাজ করার সময় যেন আপনার সঙ্গে কোনো সখা না থাকে।  
৬. যদি অনেক বই কেনার প্ল্যান থাকে, সঙ্গে রাখুন একজন বিশ্বস্ত মালবাহী ভেড়া ;)

বইমেলা ঘুরুন ও ঘোরান।

Monday, January 26, 2015

ভোওওওওওওওওওওওরসা!

টুবুলদের ছাদ থেকে একটা সাদা-বেগুনি মুখপোড়া বেড়ে উঠে ছোটকার পাছা টা কেটে দিয়েছে এইমাত্র। ওটাকে লটকাতে হবে। টুবুলের বোন আছে ছাদে। ইজ্জৎ কা সওয়াল। ময়ূরকণ্ঠী টা দিয়েই মাত করতে হবে। ঢিল ঢিল দে হারামজাদা! লাটাই ধরতে পারে না আবার ঘুড়ি ওড়ানোর শখ!

টুবুল, পটকা, বুবাই, চানু সবাই আজ প্রতিপক্ষ। ছাদে এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে একতে দোতে মুখপোড়া পেটকাটির লাল কালো সাদা সবুজ শরীর, লাটাই, আঠার গামলা, ব্যান্ড এইড। মারকাটারি প্যাঁচের খেলায় শহীদ হচ্ছে ঘুড়ি, কাটা যাচ্ছে নাক, বেজে উঠছে কাঁসর ঘন্টা বিজয়ী ছাদে।

সুতো ছেড়ে, টেনে, বেড়ে, ক্রমে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে দুপুরের আকাশ। ভিলেন নারকোল গাছ খেয়ে নিচ্ছে পাঁচতের ভি আই পি গুমর। পটকার মায়ের সাধের প্যানসি আর ডালিয়া ফুলগাছ আজ এই মহারণে উলুখাগড়ার মত প্রাণ দিয়েছে তেতলার আলসে থেকে একতলার উঠোনে পতিত হয়ে।

টুবুলের বোন সানগ্লাস পরে আড়চোখে নজর রেখেছে ডাঁয়ে বাঁয়ের ছাদে। হাবুলের মেজোপিসির ছেলে মাঞ্জায় দু হাত কেটে রিটায়ার্ড হার্ট। বাবলু প্রেমিকার এসএমএস-এর উত্তর দিতে গিয়ে, মুহুর্তের অসাবধানতায় একখানা মোক্ষম মোমবাতি খুইয়ে ডিপ্রেশনে চলে গেছে।

ছোটকার পাঁচ বছরের মেয়ের ট্রেনিং চলছে। ছাদের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া সুতো দেখলেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শিখে গেছে সে। পারিপিসিকে সুকৌশলে ম্যানেজ করে, বুড়িকে দিইয়ে ঢিলে ঘুড়ি বেঁধে নিজেদের ছাদে ট্রান্সফারও করিয়ে ফেলেছে কিকরে কে জানে। আর টুবুলের মাসতুতো ভাই ছোটকার পাছা, বিশুদার পেটকাটি আর চানুর বগগা কেটে এখন হিরো।

সাদা বেগুনি মুখপোড়াটা টার্গেট করে বাড়ছে একটা কমলা-সবুজ ময়ূরকণ্ঠী। ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই করে উড়ে চলেছে ময়ূরকণ্ঠী সাদা-বেগুনি মুখপোড়ার দিকে। টানটান সুতো, খানখান করবে যেকোনো একজনের ঘুড়িয়াল ইমেজ। আর ঠিক তখনই প্যাঁচ এবং...

Friday, January 23, 2015

আমি পেরুমল

আপনি একটি গাধা। তাজমহল দেখলে আমার ওলকপির কথা মনে পড়ে। ভ্যান গখের সূর্যমুখিগুলো দেখে আমার মনে কোনো কবিতার বা মুগ্ধতার ভাব জাগে না। রবি ঠাকুরের কবিতা আবার হেব্বি বোরিং লাগে। পুর্ণিমার চাঁদ দেখলে মোটে প্রেম পায় না। উত্তম কুমার অত্যন্ত মেয়েলী লোক। বিরিয়ানি অতি কুচ্ছিৎ খেতে।

হতেই পারে এগুলো আমার মত। হতেই পারে এগুলো আপনার ধর্ম বা অধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করে। বা আপনার বিশ্বাসের বর্মে নাহক খানিক ফাটল ধরায়। আপনার সঙ্গে আমার যে সব মতে মিলবে, এমন দাসখত কেই বা কবে সই করেছি? করিনি তো? নাকি আমি আমার মত প্রকাশ করায় আপনার বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে না? বা আপনার ছেলেপুলেদের স্কুলে ঢুকতে দিচ্ছে না? কি বললেন? না? সবকটা প্রশ্নের উত্তরই না?

তাই যদি হবে মশাই, আমার গলা কথায় কথায় কাটতে আসেন কেন? কেন আমি ছবি আঁকলে বোম মারেন? গল্প লিখলে বই পোড়ান? কেন ক্ষমা চেয়ে মুচলেখা লেখান? সরস্বতীদত্ত একখান কলম তো যদ্দূর আমি জানি আপনারও আছে। নাহয় তাতে ধার আমার চাইতে কম, কিন্তু কলম ত কলমই বন্ধু। কলম ধরে আমার বাপ চোদ্দপুরুষের গুষ্টির তুষ্টি করুন। আমার ছেলেবেলার নিজ-বিষ্ঠা ভক্ষণের গল্প লিফলেটে ছাপিয়ে উড়িয়ে দিন শহিদ মিনারের মাথা থেকে। তবে বুঝব আপনি বাপের ব্যাটা। আর তাতেই আখেরে আপনারও লাভ।

শত্রুকে নিয়ে বেশি বুকনিবাজি করলে কী হয় জানেন তো? শত্রু ব্যাটাই ফুটেজ খায়। ঠিক আপনাদের মহাকাব্যের কর্ণ আর ইন্দ্রজিতের মত। পাবলিকের মন তো এমনিতেই খুব নরম। মার খাওয়া লোকের জন্য তাদের প্রাণ সদা আউলায়। মিটিং মিছিল বকতিমের চোটে এঁটেল মাটিতেও ধুলোর ঝড় ওঠে। আর আমার মাথার পেছনে রাতারাতি গজিয়ে ওঠে জ্যোতির্বলয়। অবিকল আপনাদের দ্যাবতাদের মতো।

Monday, January 19, 2015

এক মাঘে শীত

শীতের দুপুর নরম রোদের হলুদ ঝিলিক
শ্যাম্পু গন্ধে বিভোর চুলে কাটছে বিলি
অলস আঙুল ছাড়িয়ে নিচ্ছে লেবুর খোসা,
মাদুর জুড়ে ছড়িয়ে ফেলছে কমলা পোষাক।
রোদ পোহাচ্ছে লাইন দিয়ে আচার বয়াম
পায়ের পাতায় বসছে জেলি পেট্রলিয়াম
নিস্তরঙ্গ পুকুর ধারের গুগলি শামুক,
এসব ছুঁয়েই চটুল ছন্দে সন্ধ্যে নামুক।

শুকনো চামড়া শিরশিরিয়ে মাঘের হাওয়া
উড়িয়ে আনুক আরব্য রাত, উলের কাঁটা মিথ্যে মিথ্যে গল্প বুনুক সঙ্গ পাওয়ার।

Sunday, January 18, 2015

কুইন্স বিউটি পার্লার

ওর নরম আঙুলগুলো আমার গাল, কপাল, চোখের পাতা, গলা, ঘাড়, কানের লতিতে ঘুরে ঘুরে, উঠে নেমে, আরাম বুলিয়ে দিতে থাকে কখনো জোরে কখনো ধীরে...ঠোঁটের চারপাশ ছুঁয়ে, চিবুক হয়ে পৌঁছে যায় ভুরুর দুই পাশে, রগ চেপে ধরে কপালের আবছা বলিরেখা মুছে দেয় অনায়াসে। মিলিয়ে দেয় ক্লান্তির কালচে ছোপ, পরাজয়ের কালিমা, অবসাদের দাগা। আরামের আতিশয্যে আর ওর আঙুলের জাদুতে একটু একটু করে গলে যাই। আমরা কেউ কারুর নাম জানিনা। জানার দরকার পড়েনি কোনওদিন। শুধু রূপচর্চা করার ইচ্ছে হলে ওদের ছোট্ট পার্লারের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি আর ওর চ্যাপটা নেপালি মুখের হাসি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় গাবদা চেয়ারে। ড্রয়ার খুলে বের করে ফেলে নানারকম কৌটো, শিশি, তুলো।  কেরানী গৃহিণী চামড়ায় বুলিয়ে দেয় ওর ম্যাজিক ওয়ান্ড। অমুক তমুকের শাশুড়ির অত্যাচারের আর নিজের ছেলের বেয়াদপির গল্প করে। কত তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাচ্ছি জানিয়ে দেয় তাও। আরও ঘনঘন যে আমার ওর কাছে যাওয়া উচিৎ, সে কথাও বলে প্রতিবারই। পাক ধরা চুলে রং করে দিতে চায়...

রিক্লাইনিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে শুনে নি ওর বকুনি আর উপদেশ। প্রশংসা করলে খুশি হই, না করলে মারাত্মক ইনসিকিউইরিটিতে ভুগতে থাকি বিগতযৌবনা হয়ে ওঠার অজানা ভয়ে। ও ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে দেবার পর উদ্বিগ্ন মুখে জেনে নি কী কী মাখতে হবে রোজ চানের আর শোবার আগে। জেনে নিই কোন অলৌকিক উপায়ে ফিরে যাওয়া যায় কুড়ির কোঠায়। 

তিন চার মাস পর পরই আমার ভারি মনকেমন করে ওর জন্যে। ওর নরম আঙুলের যত্নের জন্যে। ওর মিঠে গলার "দ্যাখো দিদি কত ফ্রেশ লাগছে এবার মুখটা" শোনার জন্য। ও আমার নাম না জানা সই। আমার কুইন্স বিউটি পার্লারের সাধারণ কর্মচারী।