Wednesday, December 24, 2014

গন্ডারের মনখারাপ



ক্রিস্টমাসের ছুটি পড়ে গেছে। চিড়িয়াখানাভিক্টোরিয়া,প্ল্যানেটোরিয়ামকলবল করছে বাবা মার হাত ধরে বেড়াতে আসা কচিকাঁচাদের কলরবে। চিড়িয়াখানায় জন্তুর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছবির সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে নিচ্ছে বাঘভাল্লুক,হাতি। আর নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলছে বাবা মা কে।
হাতির সামনে যেটা ঝুলছে ওটা ল্যাজ নয় কেন?”
জিরাফের গলা অত লম্বা হল কিকরে?”
বাঘটা কি শুধু মাংস খায়আর বিরিয়ানি খায় না?”
চিড়িয়াখানায় সেদিন এক অদ্ভুত মন ভালো করা আবহাওয়া।
তারই মাঝে হঠাৎ হৈ চৈ। গণ্ডারের খাঁচার দিক থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসছে। কিসের শব্দ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেউ কেউ গোলমালের আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি টিফিন বাক্স টাক্স বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকায়ঝামেলা এড়াবে বলে। আর একদল একে একে জমা হতে থাকে গণ্ডারের খাঁচার সামনে। ব্যপারটা ঠিক কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দ্রুত লোক পাঠায় গণ্ডারের খাঁচায়কি ব্যপার সরেজমিনে জানতে। এদিকে শব্দটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে বোধগম্যও হয়ে উঠছে। শব্দটা কান্নার। ফুঁপিয়ে কান্না নয়। বেশ গলা ফাটিয়ে হাউ হাউ করে কান্নার শব্দ আসছে গণ্ডারের খাঁচার দিক থেকে। সবাই অবাক। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।
তখন গণ্ডারের কেয়ারটেকার গেলো বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করতে। কিন্তু কাকে বোঝাবে। সে বুঝলে তোতার তো কথা নেই বার্তা নেই শুধু হাউ হাউ করে কান্না। বলি ব্যপারখানা কি?খিদে পেয়েছেকোনো বাচ্চা ঢিল ছুঁড়ে মেরেছেশিং ব্যথা করছেনাহ। কিছুতেই কিছু হয় না। গণ্ডারের কান্না আর থামেই না। কান্নার কারণও বোঝা যায় না।
অনেকক্ষণ পর সে একটূ সামলাতে সে কেয়ারটেকারকে সব খুলে বলল।
গণ্ডার বাবাজির ডিপ্রেশনের কারণ ‘insecurity complex’হঠাৎ তার মনে কে যেন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেযাদবপুর ইউনিভার্সিটির ভিসির চামড়া নাকি তার চামড়ার থেকেও মোটা। সেই ভয়েই গণ্ডারের এবারের ক্রিস্টমাসটা মাটি হল।

Tuesday, December 23, 2014

কালিঘাটে বিরিঞ্চিবাবা

কালিঘাটের এক টালির ছাদওয়ালা বাড়িতে সেদিন বিরিঞ্চিবাবার সান্ধ্য সভা বসেছে। কর্ত্রী মহোদয়ার ইচ্ছে, বাবা তাঁর ভবিষ্যৎ বলে দিন।

কর্ত্রীঃ বাবা! আমার বড় সর্বনাশ হয়েছে বাবা। বড় দুঃসময় ঘনিয়ে এসেছে। ছবি আঁকায় মনে বসছে না, লিখতে বসলে এক লাইনও মাথায় আসছে না। আমার কি হবে বলে দিন বাবা।

বাবাঃ তোকে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে! দাঁড়া দাঁড়া মনে করতে দে (কর্ত্রীর হাত ধরে চোখ বন্ধ করলেন)। চোখ খুলে - হ্যাঁ মনে পড়েছে। খোলস বদলে জন্মেছিস তো তাই মনে করতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল আর কি। তা ভালো ভালো...পুরুষ জন্মে শিল্পবোধ তীব্র হলে পরের জন্মে নারীর দেহ ধারণ করাই স্বাভাবিক। তাও তো হয়ে গেল প্রায় দু হাজার বছর আগের কথা। তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল রোমে। তুই তখন রোমের সিংহাসনে বসেছিস। দোর্দন্ডপ্রতাপ  সম্রাট। এক হাতে একের পর এক বিদ্রোহ দমন করছিস, অন্য হাতে একের পর এক নিত্যি নতুন থিয়েটার উদ্বোধন করছিস, খেলাধুলোর উন্নতির জন্য ক্লাবগুলোকে হাত খুলে টাকা দিচ্ছিস, সে এক রমরমে রোম তখন। রাজ্য তো নয় যেন বারোমেসে কার্নিভ্যাল! সেই সময়ে তোর সাথে আমার দেখা। পেত্রনিয়াসের নাটক দেখতে গিয়ে। নাটকের শেষে তুই কত গল্প করলি, বললি রোমকে তুই সেরা শহর বানাতে চাস। আমি বলেছিলাম সে তুমি কর, কিন্তু শুধু নাটক নভেল করে তো আর দেশ চলবে না, রাজ্যপাটের দিকেও তোমায় সমান নজর দিতে হবে। তুই চোখ ছলছলিয়ে বলেছিলি, "এসব যে আমার একটুও ভালো লাগে না বাবা। রাজ্যপাট নেওয়ার আগে আমি বুঝিনি এত দায়িত্ব নিতে হবে। ভেবেছিলাম দিব্যি বেহালা বাজিয়ে, নেচে কুঁদে দিন কেটে যাবে।" উফ সেদিন সেকি কান্না তোর। শেষে আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললাম "ঠিক আছে ঠিক আছে, এখন চলো তো ছাদে, তোমার বেহালা শুনি একটু।" তুই শুনিয়েওছিলিস। খাসা হাত ছিল তোর। যেমন তালজ্ঞান যেমন সুরের মুর্ছনা। বাজাতে বাজাতে এমন মোহিত হয়ে গেছিলিস যে আমি তোকে না বলেই সেদিন চলে এসেছিলাম। সেই রাতেই আমার রোম ছাড়ার কথা। পরে অবশ্য শুনেছিলাম তুই যখন বেহালা বাজাচ্ছিলিস তখন কারা যেন শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু তোর শিল্পী মন, ওসব ছোটখাটো আগুনের আঁচ গায়ে মাখলে চলে? 

এবারে সব মনে পড়ে গেছে মা! তুই তো আমাদের নিরো রে, সেই সম্রাট নিরো। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না মা, তুই শিল্প চর্চা করে যা। ওই তোর ভবিষ্যৎ। ওতেই তোর পয়, ওতেই লক্ষ্মী। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সাধনা করে যা, দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কর্ত্রী: কিন্তু বাবা ওরা যে আমার পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে বাবা।

বাবা: জানি রে জানি সব জানি। এটুকুতে বিচলিত হলে তোর চলবে কেন! আমি জানি ওরা বলছে যে তুই সুদখোরের টাকায় ভাই ভাইপোকে মোচ্ছব করতে দিয়েছিস। ওরা জানে না ইতিহাসে তোর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে মা সারদার নাম জনমানসে ফিরিয়ে আনার জন্য। সারদা বড় ভালো মেয়ে ছিল রে! তুই রোজ সূর্যাস্তের আগে পরে রামকৃষ্ণের নাম জপ কর।

কর্ত্রী: তাতে কি হবে বাবা?

বাবা: ওরে পাগলী সেই তো সারদার গুরু রে। সে যদি তাকে ডেকে পাঠায় সারদা কি না গিয়ে থাকতে পারবে? সে তখন ঠিক তোকে ছেড়ে তার স্বামীর ঘরে উঠবে। এই তোর পরিত্রাণের একমাত্র রাস্তা। জপ কর জপ কর...

(চোখ বুজে - রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ...)

Monday, December 22, 2014

সঠিক ভাড়া দিন

সদ্য কাটা চুলের ঢেউ খেলানো সেটিং এলোমেলো করে দিতে উদগ্রীব প্রেমিক নয়, উত্তুরে হাওয়াই কাফি। লিপস্টিকের স্ট্রবেরি রঙ মুছে নিতে আছে এসপ্রেসোর মসৃণ ফেনিল ক্রীম। ধুলোর শহরের রাস্তার পার্কে যে গোলাপ ফুটেছে লাল সাদা হলুদ পোষাকে, তাদের কাঁটার ছুঁচলো তীব্রতা কোনও পেলব বিরহের কব্জিতে লিখবে না ছেড়ে যাওয়ার নাম। তাদের সবটুকু বিষ তোলা থাক সরকারি মালির অভ্যস্ত আঙুলের জন্য। একাকিত্বের মাধুর্যে শহর চষে ফেলা একজোড়া স্নিকার্স যখন থমকে দাঁড়িয়ে কুন্দনের দুলের দরদাম করে, গড়িয়াহাটের মোড়ে লাল সিগনালে তখন বসন্তকাল ঘাপটি মেরে মুখে ফাউন্ডেশন লাগায় আসন্ন সন্ধের অপেক্ষায়। অদূরে ষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে হাত গলিয়ে শাঁখা পলার শব্দ কয়েকদিনের বিশ্রাম আর স্বাধীনতা কেনে সঠিক ভাড়া দিয়ে।

Sunday, December 21, 2014

ভোলা বাবা পার করেগা

তোমার চকচকে গায়ের ঈষৎ কমলা আভা, আলো পিছলে যাওয়া উজ্জ্বল ত্বকের গ্ল্যামর ঠিকরে বেরনো হাতছানি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু দু পা গিয়েই ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। তোমাকে ছেড়ে চলে যাবার পাপ ধম্মে সইতো না যে! তোমাকে দেখা ইস্তক মনে মনে ছক কষতে শুরু করেছিলাম সর্ষে বাটা না, টমেটো ক্যাপসিকাম ধনেপাতা, না কড়কড়ে করে ভাজা...এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কোত্থেকে আর এক বুড়ো এসে আমার আগেই হাঁটু গেড়ে বসে তোমার দিকে হাত বাড়াতে যাবে, ওমনি আমি প্রায় ঈগলের মতোই ছোঁ মারলাম। পাঁচখানা বড় দেখে বেছে তুলে বললাম 'ওজন করুন তো'।

অমন নধর টাটকা ভোলা মাছ ফেলে চলে এলে যে রবিবারের খেঁটন ঠাকুর পাপ দেবে!

বেশ পেট আইঢাই করার মত বেশি রকম না খেলে কি আর রবিবারের মান থাকে? খেয়েদেয়ে, মুখে দুটো বাড়িতে শুকনো আমলকি ফেলে, ছাদে বসে পিঠে রোদ মেখে রবিবাসরীয় না পড়তে পারলে বৃথাই মানবজীবন, বৃথাই শীতকাল, বৃথা এ বঙ্গদেশ...

Thursday, December 18, 2014

ডিসেম্বর কে

প্রিয় ডিসেম্বর,
একটা সময় ছিল, যখন তোমার নাম শুনলেই কড়াইশুঁটির কচুরি, ফুলকপির সিঙ্গাড়া, গাজরের হালুয়া আর খেজুর গুড়ের কথা মনে হত। চিড়িয়াখানার সবুজ ঘাসে শতরঞ্চি বিছিয়ে দল বেঁধে লুচি আর নতুন আলুর দম খাবার ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। কিন্তু আজকাল কি হয়েছে কে জানে, তোমার নাম শুনলে কেবলই রক্তের কথা মনে হয়। আগুনের কথা, বুলেটের কথা, হাহাকারের কথা মনে হয়। তুমি কবে থেকে এমন রক্তপিপাসু হয়ে উঠলে বলতে পার? নির্ভয়ার জন্য, পেশোয়ারের ফুলের মত শিশুদের জন্য কি তোমার কাছ থেকে একরত্তি সহানুভূতিও আমরা আশা করতে পারি না? তুমি তো চন্দ্রমল্লিকার মাস! এত উদাসীনতা কি তোমাকে মানায়?

রক্ত

ঈশ্বর, আর একটা কর্ম ব্যস্ত দিনের শেষে যখন তুমি সুগন্ধি সিগার ধরিয়ে আরামকেদারায় মৌজ করছিলে তখন, ঠিক তখনই ওরা তোমার সই করা ফরমান হাতে নিয়ে বুলেট গাঁথছিল নরম একরত্তি সব শরীরে। তামাকের মৌতাতে তোমার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল নিশ্চই কারণ তুমি একদল নিরীহ শিশুর চিৎকার শুনতে পাওনি। জরুরী টেলিগ্রাম করে ফেরার আদেশ দাওনি তোমার সৈনিকদের। সুদৃশ্য ক্রিস্টালের গ্লাসে শিশুরক্ত পান করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেপেছিলে চামড়ার ক্রমবর্ধমান জৌলুশ। বেহালার করুণ আবহসঙ্গীত তোমাকে বুঝতে দেয়নি শরীরের অনুপস্হিতি। ঝাড়লন্ঠনের বাহারি হলুদ আলোয় আয়নার মায়াবী ছায়া দেখে ওদের মতই তুমিও বিশ্বাস করো, তুমি আছো। চিয়ার্সের ভঙ্গিতে গ্লাস তুলে মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে বলে ওঠো - 'আমিই সর্বশক্তিমান'॥

মদন্যক

সমস্ত দিন জেলের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে নিজের সেলে দেওয়ালের কাছ ঘেঁষিয়া বসিয়া ছিলাম। নিকটেই একটি খুনের আসামি পোঁদ উল্টাইয়া ঘুমাইতেছে। চুপ করিয়া খানিকটা বসিয়া ঐ আসামির ক্লান্ত ঘুম দেখিয়া হঠাৎ মনে হইল যেন কোনো পাঁচতারা হোটেলে পার্টির শেষে ভোররাতে নেশার ঘোরে কার্পেটে বসিয়া আছি। আর ঐ আসামি আমার কোনো সহচর মাতাল। পরক্ষণেই বিকেলের ঘন্টার আওয়াজে সে ভ্রম ঘুচিল।
অনেক দিনের কথা হইলেও কালকার কথা মনে হয়।
জেলের ভিতরের পরিশ্রম চোখ রাঙানির মধ্যে অহরহ ডুবিয়া থাকিয়া এখন যখন মহাকরণ, কি পাঁচতারা হোটেল, সেই ফুর্তি, সেই মামণির মেলা, সেই স্কচ, সেই সিঙ্গল মল্ট, সেই হুইস্কি, সেই চাটুকারের দল, সেই টলিউড, সেই নায়িকার কোল, সেই আমোদ প্রমোদের কথা ভাবি, তখন মনে হয় বুঝি কোন অবসর-রাতের শেষে খোঁয়াড়ির ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, জীবনে এমন দিন কখনো আসে নাই।

শীতের আদর

তেলেভাজার দোকানের কালো কড়ায় টগবগে তেলের মধ্যে আকুলিবিকুলি করতে থাকা আলুর চপের ফ্যাকাসে হলুদ থেকে সোনালী, সোনালী থেকে বাদামী হয়ে ওঠার মুচমুচে দৃশ্য দেখে যে চাঞ্চল্য বুক এবং মুখের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তার থেকেই বুঝতে পারি, শীতকাল এসে গেছে। বালিশের রোদ রোদ গন্ধ, সপ্তাহান্তের মিষ্টি মিষ্টি কাজু কিশমিশ কড়াইশুঁটি গাজর দেওয়া ফ্রায়েড রাইসও মনে করিয়ে দেয়, এ পৌষমাস - এ সময় সর্বনাশের নয়। জেলুসিলের শিশি এখন কদিন ভুলে থাকলেও চলবে। সাদা মূলো, ধনেপাতা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা জূঁঈফূলের মত এক বাটি মুড়ি আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের কাছে ফিরব বলে ছটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই অফ করি অফিসের কম্পিউটার। খাদি থেকে কেনা কাঁচের শিশির মধু কড়মড়ে টোষ্টের গায়ে আদর করে লেপ্টে যাবে বলে মুখিয়ে থাকে। সকালের সব্জি বাজার চকচকে টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজকলি, সাজিয়ে মুখ টিপে হাসে। রবিবার ভোরে রেলের ওপার থেকে মাটির কলসির মুখে উদগ্রীব ফেনার যৌবন সাজিয়ে হেঁকে যায় খেজুরের রসওয়ালা। সাধারণ পায়েস রসগোল্লায় কোন ম্যাজিকে কে জানে, আচমকা মিশে যায় খেজুর গুড়ের হাত নিশপিশ করা গন্ধ।
আঁচলে পৌষ-মাঘ বেঁধে জিভ দিয়ে শুষে নি শীতের রঙিন আদর। 

নিশি

ঘুম টা ভেঙ্গে গেল। আচমকা। জমাট নিরেট রাত। সুইচবোর্ডের লাল আলোটা চেয়ে আছে। সিঁড়ির ঘড়িটা টিক টিক টিক টিক করে চলেছে, চলেছেই। ভয় করছে। চোখ বন্ধ করলেই গলার কাছটায় ডেলা পাকাচ্ছে ভয়। অনেকদিন আগে এরমই এক ভয়ের রাতে বাথরুমে গিয়ে বাঁ হাতের শিরায় ফাঁকা সিরিঞ্জের ছুঁচ বিঁধিয়ে দিয়েছিল সে। বুড়ো আঙুলটা ডান্ডার মাথার চাকতিটায় চেপে ধরে আস্তে আস্তে ঠেলতে শুরু করেছিল। নীল শিরাটা হাওয়ার চাপে একটু ফুলে উঠতেই অবশ্য আঙ্গুল সরিয়ে নিয়েছিল। বার করে নিয়েছিল ছুঁচ। শিরাটা কিছুদিন ফুলে ছিল। তারপর আবার আগের মতন। কেউ খেয়াল করেনি। বাথরুমে যাবে না সে। ক্যাবিনেটের আয়নায় নিজের ফোলা মুখটা রাতে দেখলে আরো ভয় হয়।

বিছানায় উঠে বসে একটা সিগারেট ধরালো। অন্ধকার ঘরে নিঃশ্বাস নিতে থাকা আগুনের মন্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভয়টা একটু কমলো। আলো ফুটলে, চান করে, খেতে বসে তিন আঙুলে গরম ভাত ডাল দিয়ে মাখতে মাখতে ভয়টা কমে আসে। ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভিড়ে, হকারের চিৎকারে, যাত্রিদের ঘামের গন্ধে আশ্বস্ত লাগে। অটোওয়ালা খুচরো চেয়ে দাঁত মুখ খিঁচোলে আরাম হয় বেশ।

অফিসের এক্সেল শীটগুলো ঠান্ডা ঘরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে আবার বিন্দু বিন্দু ভয় বুকে দানা বাঁধে। সন্ধ্যেয় বেরিয়ে পানশালায় হাজিরা দিতে হয়। দু'হাতে বিয়ারের ঠান্ডা গ্লাসটা ধরে বেশ ভালো লাগে। উষ্ণ লাগে। সোনালি তরলে বুদবুদের মরে যাওয়া দেখে শান্তি হয়। 

সিগারেটটা শেষ। আবার হাতটা খালি হয়ে যায়। বালিশের নিচে থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে। দু'হাতে চেপে ধরে চিত হয়ে জোড়া হাত বুকের ওপরে রেখে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে। হাতদুটো ঘেমে উঠছে। ঘুম আসবে। ঘুম আসছে।

নামগুলো একা পড়ে থাকে লকআউট কারখানার মত

ষ্টিলের থালার গায়ে খোদাই করা থাকে "কটকটিকে সোনামা"| সঞ্চয়িতার প্রথম পাতায় লাল কালিতে জ্বলজ্বল করে "গাবলুর উপনয়নে বদুয়া"| কিছু নাম রয়ে যায় মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্টে| আর কতকগুলো স্রেফ হারিয়ে যায় মানুষগুলোর সঙ্গে| মনে থেকে যায়, কানে শোনা যায় না| নামের কপিরাইট হাতবদল হয় না| নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা মুখগুলো হয়তো দেখা দেয় এলবামে, বিয়ের, অন্নপ্রাশনের ভিডিওতে| কিন্তু নামের ডাকগুলো কি শোনা যায় আর? 

একতলা থেকে গলা ফাটিয়ে খেতে বসতে আসার ডাক, বিজয়া দশমীতে রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে ঢুকতে ঢুকতে উঠোন কাঁপানো ডাক...হারিয়ে যায় সব| বুকের ভেতরে শুধু পাথর জমতে থাকে| ধ্বনি দিলেও প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় না| 

কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে

অপার্থিব কথাটার মানে বুঝেছিলাম গত কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে| সন্ধ্যে তখন সাতটা হবে| ভুটানের পুনাখায় নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি| ওপারে পুনাখা জঙ হলুদ আলো মেখে ঘুমে| পাহাড়ের মাথাগুলো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে| মাঝে মাঝে দূর থেকে টুরিস্ট, ড্রাইভারদের কথা হাসির টুকরো শব্দ ছিটকে আসছে কানে| ক্যামেরা আর ফোনের চার্জ শেষ| সময়ও| গাড়ি অপেক্ষা করছে| ওয়াঙদিফদ্রং যেতে হবে| হঠাত কী মনে করে কে জানে, একটা বিশাল বিকট চাঁদ পাহাড়ের আড়াল থেকে বিনা ভূমিকায় বেরিয়ে এল| অন্ধকারে নদীর রুপোলি আলো চোখের তারা ছুঁলো| মনে পড়ে গেল আজ কোজাগরী পূর্ণিমা| বুকের ভেতর ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো জোয়ারের জল - ভরা কোটালের ঢেউ মাংসগন্ধ পাওয়া বেপরোয়া যুবতীর মতো চাঁদের দিকে ছুঁড়তে লাগলো ফেনিল ইশারা| মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খেতেই থাকলো কার্তিকের জ্যোত্স্নার প্রান্তরে| হৃতপিন্ডের তালে তালেই প্রায় একটা একটা পাড়ের নুড়ি গলে মিশে যায় তরল রুপোয়| তলপেট, কোমর, বুক ছাপিয়ে ওঠে রুপোলি জল| গাড়ির ড্রাইভার অধৈর্য্য আঙুল চাপে হর্নে| 

এত সুন্দর আমি জীবনে দেখিনি!