Sunday, May 17, 2015

ছাদ

গ্রীষ্মের রাতের এই এক মজা। এক একটা হাওয়ার ঢেউ আসে, আর চারপাশের সুপুরি নারকোল গাছের পাতারা সরসর ঝরঝর খরখর শব্দে দলে দুলে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। ঢেউ চলে গেলে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে পরের ঢেউটার জন্য। কিন্তু লোহার সিঁড়ির রেলিং ধরে বেয়ে ওঠা বিলিতি ফুলের গাছের সেসব উত্তেজনার বালাই নেই। পায়ের তলায় অল্প মাটি। ওর রেলিং ধরে বাঁচা। তাই নির্লিপ্তি প্র্যাকটিস করছে। ঝড় বাদল কালবোশেখি শিলাবৃষ্টি দখিনা বাতাস সবেতেই তিরতির তিরিতির করে কাঁপে। সে কাঁপুনিতে উল্লাসও নেই, উত্তেজনাও নেই, উন্মাদনাও নেই। শুধু নিজের বাঁচটুকুতে কনসেন্ট্রেট করেছে। আর আমি রাতে ছাদের লোহার সিঁড়িতে বসে হাওয়া খাই। কয়েকধাপ নীচে সিমেন্টের মেঝেতে, আলসেয় বসে সাইকাস, বেল, জবা, গোলাপ, নয়নতারা, ফার্ন, লিলি, লাল ফুলওয়ালা ক্যাকটাসের ছোট, বড়, মাঝারি, চ্যাপ্টা, লম্বাটে, গোলাকার মাটির টব, চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘুমোয়, মাঝে উসখুস করে, থম মেরে ঘাড় গুঁজে হাইওয়ের ধুলোর মতো জমতে দেয় গায়ে অন্ধকার চিরে ছড়িয়ে পড়া উঁচু বাতিস্থম্ভের জোরালো সাদা আলো। দূরে দূরের কোনো ছাদে সিগারেটের লাল আগুন কমছে বাড়ছে, ঘোরাফেরা করছে স্মার্টফোনের আলো। কথা বলার, আগুন ছোঁয়ার বেয়াড়া অভ্যেসে রাত জাগছে পায়চারীর ছাদ।

হয়ে গেল চশমা



সঃ আজ বাজার খুব খারাপ।

অঃ কত গেল?

সঃ হাজার দেড়েক।

অঃ ও মেকআপ হয়ে যাবে। খেয়াল রাখিস লস যেন পাঁচ হাজার না ছাড়ায়।

যঃ কাল ছোট মাসি ফোন করেছিল। ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ওর বিয়েতে কিন্তু ভালো কিছু দিতে হবে মনে রেখো। আমাদের মাইক্রোওয়েভ দিয়েছিল। অন্তত হাজার পাঁচেক বাজেট ধরে রাখো। আমিও কিছু দেব, চিন্তা কোরো না।

লঃ হুম।

যঃ কী হল?

লঃ কই কিছু না তো। শুনলাম।

যঃ ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই ওমনি শুনে নিলে? কী করো বলত সারাক্ষণ? কার সাথে এত কথা বলো? আমি কি কিছুই বুঝি না ভাবো?

লঃ যাহ বাবা! চোখ দিয়ে তো শুনি না। কান দিয়ে শুনি। যা বললে শুনে নিয়েছি। তোমার ছোট মাসির ছেলের বিয়ে। গিফটের বাজেট পাঁচ। শান্তি?

গঃ হ্যালো। কেমন আছিস?

ফঃ এই তো চলছে, বল।

গঃ শোন না, একটা দরকারে ফোন করলাম। মাইক্রোওয়েভে ভাপা ইলিশ করতে হলে কতক্ষণ সময় দেওয়া উচিৎ রে?

ফঃ পাঁচ মিনিট।

কঃ এই তোমার পাঁচ মিনিট? সবসময় এত ঢপ দাও কেন বলো দেখি? মোবাইল ফোনে কথা বলা মানেই ঢপ? এই নাকি তুমি অটো থেকে নামছ?

পঃ আরে! সত্যিই। লাস্ট মোমেন্টে সিগনাল খেয়ে গেলাম। নইলে পাঁচ মিনিটই লাগত। মাইরি বলছি। তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।

কঃ আমার গা ছোঁয়ার জন্য আজকাল তোমাকে এসব ভুলভাল বাহানা দিতে হচ্ছে বুঝি?

রঃ একজন কাউকে ছুঁয়ে থাকতে হবে।

টঃ একটা ঠান্ডা দেহ, কে ছুঁয়ে থাকল কি থাকল না তাতে আর কার কিই বা যায় আসে বলত? শেষ তো সেই আগুন, সেই গঙ্গায়। এসব ফুল ধূপ আতরেরই বা কী দরকার!

রঃ আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। পা টা ছুঁয়ে বসে থাক শুধু। আর কাকিমাকে বলিস একটু লোহা, নিমপাতা, আগুন আর মিষ্টির আয়োজন করে রাখতে। শ্মশানযাত্রীরা ফিরলে লাগবে।

শ্মশানযাত্রীরা সদলবলে একটা মানুষকে আগুনের দিকে ঠেলে দেবে বলে মহাসমারোহে কাঁধে তুলে নেয়, হরিবোল দিতে দিতে, খৈ আর খুচরো পয়সা ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে চলে, গাড়িঘোড়া লোকজন তাদের সসম্ভ্রমে রাস্তা করে দেয়, কেউ কেউ কপালে হাত ছোঁয়ায়, আর কেউ মৃতদেহ দেখবে না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় চট করে। ঘাটের পুরোহিত ডোম, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। শ্মশানের এক কোণে একটা ঝুপড়ির সামনে এক বিহারি দম্পতি একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বসে আছে সকাল থেকে। গঙ্গায় চান করে ভিজে কাপড়ে বসে আছে ওরা। খালি পেটে। পাগলা বাবার আদেশে। ওই একটা মড়া এলো।

র: ওই বুড়োটা কী করে রে?

জ: শুনেছি মৃগী টিগি সারিয়ে দেয়। মন্ত্রপূত লিট্টি খাইয়ে। সবাই পাগলা বাবা বলে ডাকে।

র: সব শালা ভন্ড।

চঃ সব পাখি মাছ খায় আর নাম হয় আমার! বাড়িতে নিজের ঘরে বসে লুকিয়ে বিলিতি মারলে কোনো উচ্চবাচ্য নেই কারুর, আর আমি সপ্তাহে একদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলেই বাওয়াল? ধুসসালা ভাল্লাগে না...।

ষঃ ওরা বাড়িতে বসে খায়। রাস্তায় রিক্সাওয়ালার সাথে খুচরো নিয়ে বচসা করে পাড়া মাথায় করে লঙ্কাকান্ড বাধায় না।  

খঃ লক্ষ্মী মেয়ে উঠে এসো। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর টর বাধালে একটা কান্ড হবে। ফাল্গুন মাস!

হঃ (গান) একে তো ফাগুন মাস দারুণ এ সময়, লেগেছে বিষম চোট কী জানি কী হয়…

ছঃ আমি তোমার কাছে, সময় ছাড়া আর কিচ্ছু কোনদিন চাইব না।

ঘঃ হ্যাঁ বরাবরই তোমার দামী জিনিসের দিকেই নজর, জানি।

ভ: একটা ক্রিমের দাম আটশো টাকা! এত দামী ক্রিম হয়!

শ: এটা এন্টি এজিং ক্রিম। এগুলো একটু দামিই হয়। তুমি এসবের কী বোঝো শুনি? আর তোমার টাকায় তো কিনিনি। তোমার এত মাথাব্যথা কীসের?

ড: নিজের টাকায় তো কিনেছ? কষ্ট করে উপার্জন করা টাকায়। এভাবে নষ্ট করার কোনো মানে হয়?

শ: আর তুমি যে তোমার কষ্ট করে উপার্জন করা দিনের পর দিন ইনভেস্ট করার নামে নষ্ট করছ তার বেলা? কোনদিন তো লাভ করেছ বলে শুনলাম না।

ড: ওটা আর এটা এক?

শ: হ্যাঁ। ওটাও বাজার। এটাও। তুমিও খদ্দের, আমিও।