Tuesday, October 28, 2014

রানি ও ভানু

রানিমার কপালে আজ চিন্তার ভাঁজ। কাচা কাপড় পরে সন্ধ্যে দিয়ে এই সময়টা তিনি ছাদে পায়চারী করেন। ইচ্ছে হলে ছবি আঁকেন বা কবিতা লেখেন। কিন্তু আজ আর সেসবে মন নেই তাঁর। রাজ্যের নানা দিক থেকে প্রায়শই নানারকম অশান্তির খবর আসছে। তিনি তাঁর প্রজাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। মুসলমান প্রজাদের খুশি করতে টাকা বিলোন, হিন্দু প্রজাদের প্রতিও তাঁর দয়া অসীম। পুজোর মন্ডপ উদ্বোধন করতে বললেই তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান। আর সব কাজ ফেলে সেখানে ছুটে যান। তিনি রানি। তাঁর টাকায় কোথায় কে কি করছে সব খবর কি রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব? ফুর্তির টাকায় যদি কেউ বোমা বানায় সে দায়িত্ব তিনি নেবেন কেন? ওদিকে আবার একদল গেরুয়াধারী লোক তাঁর বিরুদ্ধে প্রজাদের খ্যাপাচ্ছে এমন খবরও তাঁর কানে আসছে। কি করে অবস্থা সামাল দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। আজ তাই তিনি ভানুব্রতকে তলব করেছেন। ভানুব্রত খুব বিশ্বস্ত। তাঁর জন্যে ভানু প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। তিনিও ভানুকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ভানু একটু দামাল। মাথা গরম হয়ে গেলে মুখে যা আসে বলে ফেলে। কিন্তু সেসব ওর মনের কথা নয় এও রানি জানেন। লোকে বোঝে না, ভানুর মতো দক্ষ সেনাপতি না থাকলে রাজ্যে শান্তি বজায় রাখা যাবে না। ভানুর ওপর তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন গেরুয়াধারী দাঙ্গাবাজগুলোকে শায়েস্তা করার। কিন্তু এবারে শুধু দায়িত্ব দিয়েই নিশ্চিন্তে বসে থাকা যাবে না। পরিস্থিতি নিজের হাতে রাখতে হলে কড়া নজর রাখার দরকার। ভানুর সঙ্গে সেই নিয়েই আলোচনা করবেন। সান্ত্রীসর্দারকে বলা আছে ভানু এলেই সোজা তাকে নিয়ে ছাদে আসতে।

সান্ত্রী - রানীমা ভানুবাবু এসেছেন।
রানি - নিয়ে এসো।
ভানু - এসেছি রানিমা। (পা ছুঁতে নিচু হয়)
রানি - দাঁড়াও দাঁড়াও, ওইসব মুসলমানদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে আসোনি তো? তাহলে আমাকে ছোঁবে না। আজ আমার মঙ্গলবারের উপোষ।
ভানু (জিভ কেটে) - ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন! ওদের ছোঁয়া ঠেকা আপনি পছন্দ করেন না তা কি আমি জানিনা? (নিচু হয়ে প্রণাম)
রানি (মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করে) - ওদের মধ্যে টাকা বিলোই আর ওদের সঙ্গে ছবি তুলি বলে তো আর নিজের জাতধম্ম জনাঞ্জলি দিতে পারি না। বোসো। শোনো ভানু, আজ তোমাকে একটা বিশেষ কারণা ডেকে পাঠিয়েছি। আমি জানি তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছ গেরুয়া শয়তানগুলোকে শায়েস্তা করার। কিন্তু আমি পুরো ঘটনার ধারাবাহিক খবরাখবর পেতে চাই। কিছু একটা ব্যবস্থা কর। তোমার লোক লাগলে নাও। আমি একশো সান্ত্রি দিতে পারি তোমাকে। দশটা দক্ষ দূত দিতে পারি। আমি খবর পেয়েছি গেরুয়াদের সর্দার অনেক দূরে বসেও সব খবর পেয়ে যায়। কিভাবে কি করবে ভেবে বলো।
ভানু - হেঁ হেঁ রানিমা আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। এই দেখুন আমি কি এনেছি আপনার জন্যে। (পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে)।
রানি - এটা কি?
ভানু - আজ্ঞে রানিমা এটা স্কোরবোর্ড। যেমন খেলায় কোন দল কত নম্বর পেল সেটা এক জায়গায় লেখা হয়, এটাও তেমনি একটা যন্ত্র। এই যে দেখতে পাচ্ছে সবুজ আর গেরুয়া বোতাম? সবুজ হল আপনার প্রজা আর গেরুয়া হল ঐ দাঙ্গাবাজের দল। ঠিক এমনি আর একটা যন্ত্র আমার কাছে থাকবে। যেই ওদের একটা লাশ পড়বে আমি গেরুয়া বোতাম টিপব আর আপনার কোনো প্রজা মারা গেলে সবুজ বোতাম টিপব ওখান থেকে, আর আপনি এখানে বসে বসেই দিব্যি দেখতে পারবেন আলো জ্বলে উঠতে। আর এই যে সাদা বোতাম এটা টিপলে দেখবেন এই স্ক্রিনে দুটো নম্বর ভেসে উঠবে, একটা গেরুয়া অক্ষরে আর একটা সবুজ অক্ষরে। এটা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন পরিস্থিতি কি।
রানি (যন্ত্র নেড়েচেড়ে হেসে) - তোমার কাজে আমি খুশি হয়েছি ভানু। এখন তুমি এসো। আর যাবার সময় সচিব মহাশয়ের সাথে দেখা করে যাবে। ওনার কাছে তোমার ইনাম রাখা আছে।
ভানু - ইয়ে রানিমা কিছু যদি মনে না করেন, ইনামটা কি জানতে পারি? বড় কৌতুহল হচ্ছে।
রানি (স্মিত হেসে) - কি আবার? অক্সিজেন সিলিন্ডার!

ভানুর প্রস্থান। রানি ছাদের আর এক কোণে গিয়ে উৎফুল্ল মনে ইজেলের সামনে দাঁড়ালেন। হাতে তুলে নিলেন রং তুলি। আজ তিনি চাকার ছবি আঁকবেন। কালচক্র।

Monday, October 27, 2014

জানে কাঁহা গ্যায়ে ওহ দিন...

প্রেমাস্পদ,

আমার তখন বয়ঃসন্ধি সবে। তুমি চোখে কালো সানগ্লাস পরে একমাথা চুল ঝাঁকিয়ে বলেছিলে "হারকে জিতনেওয়ালেকো বাজিগর কেহতে হ্যায়। ক্যা কেহতে হ্যায়? বাজিগর।" ব্যস। সেই থেকে তুমি যতবার যত নায়িকাকে প্রেম নিবেদন করেছ, মনে মনে জেনেছি আসলে সেসব আমাকেই বলছ। যতবার শয়তান ভিলেনের হাতে মার খেয়ে মুখের রক্ত তুলেছ, দু হাতে চোখ ঢেকেছি। যতবার দু'হাত বুকের দুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছ, তোমার বুকে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বাবা-মা কে লুকিয়ে তোমার ছবি কিনে মুড়ে রেখে দিয়েছি বইএর ড্রয়ারের নীচে। পুজোয় বায়না করে তোমার নায়িকার মতোই টিউনিক কিনে দুটো ঝুঁটি বেঁধে ঘুরেছি প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে। পাড়ার হিরোদের মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে দিয়ে নাক উঁচিয়ে হেঁটে চলে গেছি হেলায়। তোমার গালের টোলে পণ করেছি জীবন। তোমার জন্যে আমি কি না করেছি বলো? ব্ল্যাকে টিকিট কেটেছি, ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড কিনেছি, চুলের ছাঁট বদলেছি। তোমার ছবির সিন এক মিনিট মিস করার ভয়ে চা, সাবান, ক্রিম, ভিকো টারমারিক এর বিজ্ঞাপন দেখেছি অধীর আগ্রহে। প্রিয় বান্ধবীর সাথে কথা বলিনি এক সপ্তাহ তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভালো বলার অপরাধে। 

কিন্তু তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসনা আগের মতো? তোমাকে যেন ঠিক চিনতে পারি না আজকাল। তোমার পেটের চার ছয় আট থাক পেশি, তামাটে গায়ের রং, কঠোর মুখভঙ্গির আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেছ তুমি। তোমার সেই চুল ঝাঁকিয়ে গালে টোল ফেলা হাসি, সেই ওভারকোট পরে দৌড়, সেই লাল টিশার্ট...এসব আমি খুব মিস করি সোনা। আমি কিন্তু বরাবরই জানতাম তুমি তোমার সমস্ত প্রতিপক্ষকে হারিয়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছবে। সক্কলের মুখে ঝামা ঘষে বসবে রাজার আসনে। আর আমার মনের সিংহাসন তো সেই কবে থেকেই তোমার, তোমার একার। কিন্তু তুমি ওদের টেক্কা দিতে গিয়ে ওদেরই মতো হয়ে উঠবে একদিন, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কোথায় গেলো আমাদের সেই সর্ষের ক্ষেত, সেই কলেজ ক্যাম্পাস, সেই বৃষ্টির রাতের গান? টাকা পয়সা প্রতিপত্তি এসব তো তুমি অনেক পেয়েছ, সোনা। আর কেন? 

এবারে তুমি ফিরে এসো আমার কাছে। ম্যান্ডোলিনটাও এনো। এসো আমরা হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাই আল্পসের ছোট্ট পাহাড়ি নদীর ওপর ঐ সাঁকোটায়। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। 

                                                                                            - ইতি
                                                                                তোমার প্রণয়পিয়াসী দাসি