Tuesday, March 24, 2015

ইন্দ্রিয়সুখ

সারি সারি হলুদ ম্যাগির চেন ঝোলানো মনোহারি দোকান, বনেট খুলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো খৈনি টেপা ট্যাক্সিওয়ালা, পান বিড়ির গুমটি, গলির জটলা চোখের পাশ দিয়ে সরে সরে যায়। উত্তম-সুচিত্রার বাইকগানের প্রেক্ষাপটের মতন। সিগনালপোস্ট রাগি চোখ লাল করে পথ আটকায় একদল হলুদ সবুজ অটোর। রাস্তা পেরতে দেয় না।

হঠাৎ হাওয়ার দমকে উড়ে যায় কবির মিউজের বুকের আঁচল। জল ছেটানো রজনীগন্ধা, এগরোল চাটুর পোড়া তেল, গেরস্তের কালোজিরে ফোড়ন, সর পড়া ফুটন্ত দুধ, বেনারসি জর্দার উগ্র গন্ধ এসে লাগে নাকে।

দূরের মিটিং এর মাইক জবাব চায় সরকারের কাছে। কন্ডাকটর শুনিয়ে দিয়ে যায় খালি সীটের হদিশ। উলোঝুলো পাগল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে থাকে দুই তিন চার অক্ষরের অভিযোগ। ব্যস্তবাগীশ অটোর হর্ন ছুটে এসে ঢুকে পড়ে কানের গর্তে। ছুঁড়ে ফেলা এঁটো ভাঁড় আছড়ে পড়ে খং করে ভেঙ্গে ছিটকে গিয়ে লাগে নেড়ি কুকুরের পেছনের পায়ে। চমকে কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে ওঠে পাড়ার ভুলু। হকারের এফএমে মাখনগলায় হেমন্ত বলে ওঠে 'সুন যা দিলকি দাস্তাঁ'।

ঘেমে পিঠের চামড়ায় লেপ্টে যাওয়া জামায় হাওয়া লাগে। মুহুর্তে শিরশিরানি নামে শিরদাঁড়া বেয়ে। কাঁটা ফুটে ওঠে সারা গায়ে। কিছুক্ষণ আগেই উপুড় করা কালো কফির তিতকুটে পরত ছড়িয়ে জড়িয়ে থাকা জিভ ঠোঁট চেটে খুঁজে পায় লিপস্টিকের চেনা স্বাদ।

একটা গোটা শহর রক পাখীর মতো উড়ে এসে প্রকান্ড ডানায় ঢেকে ফেলে শরীরের শিরা, উপশিরা, দাগ, খাঁজ, ভাঁজ ঢেউ। অযথা আদর করে।



Wednesday, March 18, 2015

মুখ এবং বুক

বহু বছর হল মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেছে। এবার বুক ঢাকার পালা। উঁহু এ বুক সে বুক নয়। এ হল book। ফেসবুক নামের যে তরঙ্গে ভেসে আমরা নিরন্তর ছুঁয়ে চলেছি ভিনদেশের, ভিনবাড়ির, ভিনজগতের জীবন তাদের ভাগ করে নেওয়া ছবির, স্ট্যাটাসের, লেখার মাধ্যমে; চ্যাট বাক্সে যাদের বলছি রাতের মেনু, কলেজের কেচ্ছা অথবা আগ্রহভরে শুনছি বিয়ে ভাঙ্গার গল্প - একদিন হঠাৎ ঠিক করলাম, এসবের থেকে বিরতি নেওয়ার দরকার। আর ভদ্রমহিলার যেহেতু এক কথা, তাই কয়েকটা ক্লিক পরপর করে, অ্যাকাউন্টখানা deactivate করে দেওয়া গেল। মেইলের বাক্সে, এসএমএস-এ কয়েকটা প্রশ্ন ছুটে এল আমার কী হয়েছে জানতে। খুচরো বৈরাগ্য শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরেও গেল।

আসলে সত্যি যদি তেমন বলার মত কিছু হতো, মানে বেশ মুখরোচক কিছু - যেমন ধরুন হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে কেউ রেপ করল, অথবা অ্যাসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিল চাঁদমুখ, অথবা কুপিয়ে খুন করে গেল, অথবা লিম্ফোসারকোমা অফ দ্য ইন্টেস্টাইনের প্রকোপে বেঘোরে প্রাণ গেল, তাহলে কিন্তু আয়েশ করে বাড়িতে বসে মাউস টিপে টিপে deactivate করে উঠতে পারতাম না প্রোফাইলখানা। উল্টে আমার অবর্তমানে সেখানা আমার স্মৃতিসৌধ হয়ে জ্বলজ্বল করত আন্তর্জাল প্রান্তরে। রাশি রাশি ছবি, লেখা, লোকদেখানো আদিখ্যেতা পড়ে থাকত একা - লোকজন মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে যেত, কমেন্ট পড়ে পড়ে বুঝে নিতে চাইত প্রেম অপ্রেম বিষাদ আহ্লাদের হদিশ। হয়তো ভাবত আহা কেমন চ্যাট আলো করে থাকত গো, কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল...চুক চুক! হয়তো ভাবত না। টাইমলাইনে এসে হয়তো লিখে যেত তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, তোমার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি, সব ঝড় কেটে যায় একদিন...এও যাবে। হয়তো যেত না। হয়তো সুর্যোদয়ের, মেঘের, গোলাপের ছবিতে ছয়লাপ করে দিত, বা দিত না।

এদিকে কবি সেই কবেই অভিযোগ করে গেছেন - শরীর শরীর তোমার মন নাই? অথচ আমাদের দেখুন, শরীরের নাগাল পাই না, ছবিকেই শরীর বানাই, মনের নাগাল না পেয়ে স্মাইলি জমাই। মুখে বুকে আঙুল বোলাতেই চালাক ফোনের থেকে একরাশ রঙিন ধোঁয়া বেরিয়ে এসে গড়ে তোলে অবয়ব। বিজন ঘরে নিশীথ রাতে সকলেই ঢুকে পড়ি শূন্য হাতে।


Monday, March 9, 2015

আপনার হিরো ওয়ার্শিপের প্রয়োজন মেটানোর দায় নির্ভয়ার নয়

রোজ একই বিষয় নিয়ে লিখতে ভালো লাগে না। কিন্তু তাও মাঝেমাঝে বাধ্য হই। আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে এনডিটিভি খুলে দেখলাম একটা প্রদীপ জ্বলছে, তার পাশে ফুলের মালা, লেখা রয়েছে India's Daughter- হিসেব মতো এ দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল আসার কথা। আবেগে গলা বুঁজে আসার কথা। নির্ভয়া তোমাকে আমরা ভুলছি না ভুলব না গোছের স্লোগান তোলার কথা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এর কোনটাই হলো না। ছবিটা দেখে প্রথমেই মনে পড়ল দিল্লির অমর জওয়ান জ্যোতির কথা। যেকোনো শহীদকে আমরা এভাবেই মনে রাখি। কিন্তু, নির্ভয়া কি শহীদ? শহীদের অহংকার কি সে চেয়েছিল?

যে মেয়েটা আমাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বেঘোরে প্রাণ দিল, তাকে আমরা শহীদ বানালাম কোন মুখে? তার মৃত্যুর দায় তো আমাদের প্রত্যেকের। আমরা যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নারী শরীর পুরুষের ভোগের বস্তু এই মনোভাব কে প্রশ্রয় দিই, যারা prevention is better than cure থিওরি মেনে নিজেকে একটু বেশি ঢাকি, যারা অধস্তন মহিলা কর্মচারীকে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে অফিসে আসতে বারণ করি, তাদের সকলের। নির্ভয়া আমাদের লজ্জা। আমাদের ব্যর্থতার মুখ। সঙ্কির্ণতার মুখ। পৈশাচিকতার মুখ। তাকে শহীদ বানিয়ে ফেললেই কি সেই দায় নেমে যাবে কাঁধ থেকে?

নির্ভয়াকে আমাদের একজন victim  হিসেবেই মনে রাখতে হবে। শহীদের গৌরবের মোড়কে তাকে ঢাকলে কি আর এই লজ্জা ঢাকা যাবে? মুকেশের শাস্তি অথবা সংশোধন, তথ্যচিত্র ব্যান করার যৌক্তিকতা, ফাঁসী কাম্য না যাবজ্জীবন, এসব বিতর্কে নাহয় নাই বা গেলাম।

শুধু বলব, একজন বেতনভুক সরকারি যোদ্ধার সঙ্গে নির্ভয়াকে গুলিয়ে ফেলবেন না। আপনার হিরো ওয়ার্শিপের প্রয়োজন মেটানোর দায় নির্ভয়ার নয়। নির্ভয়া আমাদের লজ্জা। প্রশাসনের, সমাজব্যবস্থার, রাষ্ট্রের, শিক্ষাব্যবস্থার,  আমার, আপনার।

Monday, March 2, 2015

কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!


আমার নাম নির্ভয়া নয়। সৌভাগ্যবশত, আমাকে কেউ কোনদিন রেপ করেনি। যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে মেরে ফেলেনি। আমার অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে ধর্নাও দেয়নি। শুধু একটু আধটু গায়ে হাত টাত দিয়েছে রাস্তাঘাটে। তবে সেসব তো জলভাত। কবি তো আগেই বলে দিয়েছেন, আপনা মাংসেই হরিণা বৈরি হবার কথা। বানভাসি কন্যার জীবনভোর সর্বনাশ হবার কথা। ঐসব বলে তাই খামোকা আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। বরং 'সভ্য বদ্র পোষাক' পরে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে চড়াই শ্রেয়। তাছাড়া আজকে নির্ভয়ার কথাই বলা দরকার। কারণ আর কিছুই নয়, নির্ভয়া কান্ডে শাস্তিপ্রাপ্ত জনৈক যুবক সদ্য তার অসহায়তার কথা এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে। তার প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জেগে উঠেছে। 

সত্যিই তো। কোনও ভদ্র মেয়ে কি রাত নটায় এক পুরুষ বন্ধু সাথে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? নাকি ধর্ষিত হবে বুঝতে পেরে সেই কাজে বাধা দেয়? নাকি অভব্য পোষাক পরে বাড়ি থেকে বেরোয়? মেয়েরা যখন জানেই, তাদের শরীর পুরুষের ভোগবিলাসের উপাদান, সেইমতো চলাই তাদের উচিৎ। অযথা সাঁকো নাড়ালে যা হবার তাই হয়। দু পায়ের ফাঁকে হামলে পড়ে পৌরুষের বজ্রনির্ঘোষ। খোয়া যায় মান, সম্মান, প্রাণ। প্রাণ গেলে অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই, কারণ তাহলে আর ভগ্ন সম্মানের বোঝা বয়ে বাকি জীবনটা বেড়াতে হয় না। উলটে শহীদের মর্যাদা জোটে কপালে। মোমবাতি মিছিলও। আর উপরি পাওনা হিসেবে কখনো আত্মীয়স্বজনের চাকরি, আর্থিক অনুদান (ক্ষতিপূরণও বলতে পারেন) ইত্যাদি। এক কথায়, সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস যাকে বলে। আর এইসব সাত পাঁচ ভেবেই নির্ভয়ারা জিন্স টপ পরে, রাত করে বাড়ি ফেরে, পুরুষবন্ধুর সাথে খোলামেলাভাবে মেশে। শুধুমাত্র ধর্ষিত হবার আশায়। 

আর তাই আমরা, আমরা যারা রেপড হইনি বা করিনি বলে যথাক্রমে প্রিভিলেজড ও এনলাইটেন্ড, তারা নির্ভয়ার দোষীদের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই সোশ্যাল মিডিয়ায়। মৃত্যুদন্ডের মতো পৈশাচিক আইনের নিন্দা করতে। আর যে বেচারা লোকটা শুধুমাত্র এক মহিলার শরীর ভোগ করতে চেয়ে তার কাছে বাধা পেয়ে তাকে নির্যাতন করতে বাধ্য হয়, সে বিদেশী চ্যানেলকে বলে, "মহিলারাই ধর্ষনের জন্য বেশি দায়ী পুরুষদের চেয়ে।" 



নির্ভয়া আর অভিজিৎ রায়ের ভাগ্য একই গোত্রের। এই ভদ্রলোককেও সুখে থাকতে ভূতে কিলিয়েছিল কোনো এককালে। নইলে কি আর সে যেচে পড়ে ধর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে মারা পড়ল? সে দায়ও কিন্তু তাকেই নিতে হবে। কারণ, যে বা যারা তাকে কুপিয়ে মারার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছে তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা, মানসিক গঠন, তারা সংখ্যালঘু না গুরু, ইত্যাদির চুলচেরা বিচার করাই সর্বাগ্রে কাম্য। নিন্দা করা কিম্বা শাস্তির দাবী, গৌণ। আহা খুনি বলে কি মানুষ নয়! তাদের কি শখ আহ্লাদ স্পর্শকাতরতা থাকতে নেই?  মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লে হুলের বিষ সহ্য করতে জানতেই হবে। 

বাড়ির বাইরে পা ফেলার আগে বা কলম ধরার আগে এ কথা মাথায় রাখতেই হবে, যে কোনো বিসদৃশ ঘটনার জন্য, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।