Thursday, February 25, 2016

আমার করের টাকায় যেখানে যা যা হয়

জে এন ইউ বিতর্ক চলাকালীন ইনফোসিস-এর এক প্রাক্তন হোমরা, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন আম আদমির ট্যাক্সের টাকায় পড়াশুনো করা ছেলেপিলের দল পড়াশুনো না করে আন্দোলন করলে তা আমি মোটে সহ্য করব না। ভাইলোগ, বলতেই হচ্ছে বক্তব্য মে দম হ্যায়। সত্যিই তো, আমার রক্ত ঘাম জল করা টাকা তো আর কারুর বাপের সম্পত্তি নয় যে তা নিয়ে ঝান্ডাবাজি করা হবে? তবে কিনা এই পোড়া দেশে, আমার আপনার ট্যাক্সের টাকায় বেড়াল পায়রার বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর প্রায় সবই হয়। কীরকম? আসুন কয়েকটা নমুনা দেখা যাক।

১। নেতার খাইখরচ - সরকারী তথ্য অনুযায়ী, সরকার এম এল এ পিছু প্রতি মাসে খরচ করে ২,৭০০০০ (দু লাখ সত্তর হাজার) টাকা। মাস মাইনে, দৈনিক ভাতা, কেন্দ্রের খরচ ছাড়াও, আছে বিনামূল্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, গাড়ির জ্বালানি, বাস ট্রেনের বিনা টিকিটে যথেচ্ছ যাতায়াতের সুবিধা, বছরে চৌত্রিশটা প্লেনের টিকিট, গোটা পরিবারের চিকিৎসার খরচ, ইত্যাদি। ৫৪৩ জন সদস্যের ট্রাভেল রিইম্বার্সমেন্ট-এ সরকারের বছরে খরচ ৮৩ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য এই দেশপ্রেমী সৈনিকদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা স্কুলের গন্ডিটুকুও পেরোননি। তাতে যদিও তাঁদের রাজনৈতিক যোগ্যতার বিচার হয়য় না, তবুও বলতে ইচ্ছে হলো তাই বললাম।
২। সামরিক খচ্চা - সেপ্টেম্বর ২০১৫ মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বিভিন্ন সামরিক খাতে সরকারের খরচ ২২৯০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাইনেকড়ি, খাওয়া দাওয়া, গোলা বন্দুক এসবের খরচ আছে।
৩। সি এস ডি ক্যান্টিন - দেশের যারা সেবা করেন, তাদের পালটা সেবা করতে সি এস ডি নামে একটি বস্তু আছে। সি এস ডি-র পুরো নাম হলো ক্যান্টিন স্টোর্স ডিপার্টমেন্ট। এই সি এস ডি কী করে? জলের দরে খাবার, মদ, টিভি ফ্রিজ, পাখা, জামা, জুতো, সুটকেস, সানগ্লাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন, গাড়ি, এসব বিক্রি করে সেনা, বায়ুসেনা, বিএসএফ, গান এন্ড শেল ইত্যাদি সামরিক-আধা সামরিক দপ্তরের কর্মচারিদের। ২০১০-১১ এর হিসেব অনুযায়ী সিএসডি ক্যান্টিনের জিনিস্পত্র কেনাকাটার জন্য সরকার বছরে ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে ক্যান্টিন প্রতি। এরকম ৩৪টা বড় ক্যান্টিন আছে সারা দেশে। সেইসব ক্যান্টিনের অধীনে আবার আরও অনেক ক্যান্টিন। এই নীচুতলার ক্যান্টিন ৪-৫% দাম বাড়িয়ে কর্মচারীদের তা বিক্রি করে। এই যে বাড়তি ৪-৫% মুনাফা, তার কী হয় কেউ জানে না। উল্লেখযোগ্য, সিএসডি-এর কোনও অডিট হয় না। আমার আপনার চেনা অনেক মদ স্মাগলার আছে, যারা ১৮০০/- টাকার মদ ১৩০০/- টাকায় বেচে। জানবেন তারা বিভিন্ন দেশভক্ত সামরিক কর্মচারীর বদান্যতায় ৭০০-৮০০ টাকায় সেগুলো কেনে।
৪। প্রজাতন্ত্র দিবস - ২০১৪ সালে সাজুগুজু করে মন্ত্রী সান্ত্রী লেঠেল বাগিয়ে, অস্ত্রাগার খুলে প্রতিবেশির মনে ভয় আর দেশবাসীর মনে ভক্তির সঞ্চয় করতে যে চার ঘন্টার লাচ প্ররিবেশিত হয়েছিল নিয়মমাফিক রাজপথে, তাতে সরকারের খরচ হয়েছিল ৩২০ কোটি টাকা
৫। বিবিধ - এই যে যিশু ঠাকুর জন্মেছিলেন বলে গোটা পার্ক স্ট্রীট আলোর মালায় সেজে ওঠে, আচমকা শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের নাম পালটে শোভাবাজার সুতানূটি করায় স্টেশনের সব নিয়ন বোর্ড পালটে ফেলতে হয় রাতারাতি, অমুক তমুককে সম্বর্ধনা দিতে হয় সোনার মুকুট মেডেল দিয়ে, বিজয় মাল্যকে লোন পাইয়ে দিতে হয় যাতে ষাট নম্বর জন্মদিনটা হেব্বি কেতায় গোয়ায় পালন করতে পারেন, এসবই ভাইয়ো বেহেনো আমাদের টাকায় হয়। আর ওই যে স্মৃতিজি ওনার আগুন ভাষণে বললেন না, ওনার কোটায় কাদের কাদের ক্যান্ডিডেটকে সীট পাইয়ে দেন? হ্যাঁ ওসবও হয়। জাতীয় কোটায় পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে না পেলেও, মন্ত্রীর কোটায় বড়লোকের ৪০% পাওয়া ছেলেমেয়েও দিব্যি ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়তে পারে।

সরকারের কী ভাগ্যি বলুন তো! আমার আপনার মতো বেহেড গবেটে দেশটা ভরে গেছে বলেই না ঘাস বিচুলি যা পারে খাইয়ে দেয় আর আমরাও পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জাবর কাটতে থাকি।

Tuesday, February 9, 2016

জাতপাত সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি আগেই জানতাম কিন্তু বলিনি


দলিত-নিগ্রহ বা 'নিচু' জাতের লোকজনকে অহেতুক হ্যাটা করার দৃশ্য আমি সত্যিই কোনদিন দেখিনি। দেখবই বা কিকরে? আমার আত্মীয়স্বজন-এর যাদের বেছে নেবার কোনও অপশন আমার কাছে ছিল না, প্রত্যেকের পদবী মোটামুটি - ব্যানার্জী, মুখার্জি, ব্যানার্জী, ব্যানার্জী, মুখার্জি, ভট্টাচার্য, রায়, গোস্বামী, বসু...পেয়েছি পেয়েছি একজন বসু আছে। হ্যাঁ আমার এক মাসতুত দিদির বরের পদবী বসু। নামের শেষে বসু আছে এমন একজনকে মেয়ে বিয়ে করবে মনস্থ করেছে শুনেই মাসি শয্যা নিয়েছিলেন। বহুদিন কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত কায়স্থ জামাইয়ের মুখদর্শন করেননি। জীবনের শেষ দশ বছর অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁকে এই বসু পরিবারের সঙ্গেই এক বাড়িতে কাটাতে হয়। সে যাকগে যাক। এবারে আসা যাক আমার বন্ধু তালিকায়। অর্থাৎ যাদের আমি যেচে আমার জীবনের অংশ করেছি। তাদের পদবীগুলো মোটামুটি এইরকম - ব্যানার্জী, চক্রবর্তি, ভট্টাচার্য, পাল, গুহ, দত্ত, দাশগুপ্ত, নাথ, মুখার্জি, অধিকারী, বিশ্বাস, বসু, রায়চৌধুরী, ব্যানার্জী, গাঙ্গুলি, মন্ডল, মিত্র, কর্মকার, সরকার, আগরওয়াল, পান্ডে, নারায়ানন, বাগ, লাহিড়ি, চৌধুরী, রায়, চ্যাটার্জি। হ্যাঁ এক দু পিস বাদে সবই সৎ ব্রাহ্মণ। নিদেনপক্ষে কায়েত। আমি বেছে বেছে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গেই দোস্তি পাতিয়েছি এমনটা ভাবতে প্রথমটায় খুব আত্মগ্লানি বোধ হলো। তারপর সেটা খন্ডাতে একটা অকাট্য যুক্তি বের করলাম। এই যে সব বন্ধুবান্ধবের দল, এদের আমি পেলাম কোথায়? কাউকে স্কুলে, কাউকে কলেজে, কাউকে ইউনিভার্সিটিতে, কাউকে অফিসে, কাউকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। এই মোটের ওপর বন্ধু কালেকশনের ঠেক। এবারে বন্ধুত্ব পাতাতে গেলে তো আর আমি পদবী দেখে পাতাইনি? পালকের রঙ দেখে পাতিয়েছি। এখন এইসব জায়গায় যে আমি বেশি বেশি করে 'নিচু' জাতের মানুষ খুঁজে পাইনি, বা বলা ভালো প্রায় সবই বর্ণহিন্দু পেয়েছি তার দায় কি আমার, না আমার পূর্বপুরুষের না বেদের না সংবিধানের শুনি?


লক্ষ্মী'র পদবী আমি জানিনা। লক্ষ্মী বিহারি। পৌরসভার ঝাড়ুদারনি। সপ্তাহে একদিন ফ্রি ল্যান্স আমার বাড়ির দুটো বাথরুম আর ড্রেন পরিষ্কার করে দিয়ে যায় সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। এছাড়া রোজ আমার বাড়িতে ওর কাজের ব্যাগটা রেখে যায়। ডিউটি শেষ করে ফেরার সময় তুলে নিয়ে যায়। লক্ষ্মী আমার মা কে 'মা' আর আমাকে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে। আমি দরজা খুলে দাঁড়ালে এক অদ্ভুত কায়দায় টুক করে 'ও যেন আমাকে টাচ না করে' স্টাইলে ভেতরে ঢুকে যায়। আর মাসের শেষে টাকা নেবার সময় দু হাত জড়ো করে আঁজলা পেতে দাঁড়ায়। আমি কিন্তু ওকে এসব করতে শেখাইনি। শুনেছি পৌরসভার কর্মী হবার সুবাদে ওরা এখন খুব খারাপ মাইনেকড়ি পায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার, অঞ্চলে বহু অশিক্ষিত বেকার বামুনের ছেলেমেয়ে থাকলেও তারা কেউ কক্ষনো এই কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করে না। বামুনের ছেলে হয়ে দেবুদা মাথায় করে মাছ ফেরি করে বেড়াত বলে পাড়ায় ঘোর বদনাম হয়েছিল।


বাবার মুখে শুনেছি বাবা যখন ছোট ছিল খুবই কিউট বাচ্চা ছিল আর এ ও সে এসে চটকে দিত, বিস্কুট লজেন্স দিত। একটা বুড়ো লোক ছিল যাকে আমার বাচ্চা বাবা নাম ধরে ডাকত আর সে আমার বাবার দেখা পেলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। বামুনের ছেলেকে প্রণাম করলে পুণ্যি হয়।


আমার এক কাকা আক্ষেপ করে একদিন বলেছিল, সমস্ত রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের নাম আজকাল সোনার চাঁদ সোনার টুকরো। হ্যাঁ সে ট্রেনে যেতে যেতে নজর রাখে স্টেশন মাস্টারের নামফলকের দিকে - পদবী দেখবে বলে।

আশা করছি এতসব স্বীকারোক্তির পরে আমাকে কেউ আর বর্ণহিন্দু বলে গাল পাড়বেন না। পাড়লেও ভারি বয়ে গেছে। কয়েকমাস পরেই আমার তুতো দিদির ছেলের পইতে। তখন কবজি ডুবিয়ে খাব। আর ব্রহ্মচারী দন্ডিঘরে থাকাকালীন তার চোখ যেন কোনও অব্রাহ্মণের দিকে না যায় সেই ব্যবস্থা করব। জয় গুরু!