Tuesday, February 9, 2016

জাতপাত সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি আগেই জানতাম কিন্তু বলিনি


দলিত-নিগ্রহ বা 'নিচু' জাতের লোকজনকে অহেতুক হ্যাটা করার দৃশ্য আমি সত্যিই কোনদিন দেখিনি। দেখবই বা কিকরে? আমার আত্মীয়স্বজন-এর যাদের বেছে নেবার কোনও অপশন আমার কাছে ছিল না, প্রত্যেকের পদবী মোটামুটি - ব্যানার্জী, মুখার্জি, ব্যানার্জী, ব্যানার্জী, মুখার্জি, ভট্টাচার্য, রায়, গোস্বামী, বসু...পেয়েছি পেয়েছি একজন বসু আছে। হ্যাঁ আমার এক মাসতুত দিদির বরের পদবী বসু। নামের শেষে বসু আছে এমন একজনকে মেয়ে বিয়ে করবে মনস্থ করেছে শুনেই মাসি শয্যা নিয়েছিলেন। বহুদিন কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত কায়স্থ জামাইয়ের মুখদর্শন করেননি। জীবনের শেষ দশ বছর অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁকে এই বসু পরিবারের সঙ্গেই এক বাড়িতে কাটাতে হয়। সে যাকগে যাক। এবারে আসা যাক আমার বন্ধু তালিকায়। অর্থাৎ যাদের আমি যেচে আমার জীবনের অংশ করেছি। তাদের পদবীগুলো মোটামুটি এইরকম - ব্যানার্জী, চক্রবর্তি, ভট্টাচার্য, পাল, গুহ, দত্ত, দাশগুপ্ত, নাথ, মুখার্জি, অধিকারী, বিশ্বাস, বসু, রায়চৌধুরী, ব্যানার্জী, গাঙ্গুলি, মন্ডল, মিত্র, কর্মকার, সরকার, আগরওয়াল, পান্ডে, নারায়ানন, বাগ, লাহিড়ি, চৌধুরী, রায়, চ্যাটার্জি। হ্যাঁ এক দু পিস বাদে সবই সৎ ব্রাহ্মণ। নিদেনপক্ষে কায়েত। আমি বেছে বেছে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গেই দোস্তি পাতিয়েছি এমনটা ভাবতে প্রথমটায় খুব আত্মগ্লানি বোধ হলো। তারপর সেটা খন্ডাতে একটা অকাট্য যুক্তি বের করলাম। এই যে সব বন্ধুবান্ধবের দল, এদের আমি পেলাম কোথায়? কাউকে স্কুলে, কাউকে কলেজে, কাউকে ইউনিভার্সিটিতে, কাউকে অফিসে, কাউকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। এই মোটের ওপর বন্ধু কালেকশনের ঠেক। এবারে বন্ধুত্ব পাতাতে গেলে তো আর আমি পদবী দেখে পাতাইনি? পালকের রঙ দেখে পাতিয়েছি। এখন এইসব জায়গায় যে আমি বেশি বেশি করে 'নিচু' জাতের মানুষ খুঁজে পাইনি, বা বলা ভালো প্রায় সবই বর্ণহিন্দু পেয়েছি তার দায় কি আমার, না আমার পূর্বপুরুষের না বেদের না সংবিধানের শুনি?


লক্ষ্মী'র পদবী আমি জানিনা। লক্ষ্মী বিহারি। পৌরসভার ঝাড়ুদারনি। সপ্তাহে একদিন ফ্রি ল্যান্স আমার বাড়ির দুটো বাথরুম আর ড্রেন পরিষ্কার করে দিয়ে যায় সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। এছাড়া রোজ আমার বাড়িতে ওর কাজের ব্যাগটা রেখে যায়। ডিউটি শেষ করে ফেরার সময় তুলে নিয়ে যায়। লক্ষ্মী আমার মা কে 'মা' আর আমাকে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে। আমি দরজা খুলে দাঁড়ালে এক অদ্ভুত কায়দায় টুক করে 'ও যেন আমাকে টাচ না করে' স্টাইলে ভেতরে ঢুকে যায়। আর মাসের শেষে টাকা নেবার সময় দু হাত জড়ো করে আঁজলা পেতে দাঁড়ায়। আমি কিন্তু ওকে এসব করতে শেখাইনি। শুনেছি পৌরসভার কর্মী হবার সুবাদে ওরা এখন খুব খারাপ মাইনেকড়ি পায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার, অঞ্চলে বহু অশিক্ষিত বেকার বামুনের ছেলেমেয়ে থাকলেও তারা কেউ কক্ষনো এই কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করে না। বামুনের ছেলে হয়ে দেবুদা মাথায় করে মাছ ফেরি করে বেড়াত বলে পাড়ায় ঘোর বদনাম হয়েছিল।


বাবার মুখে শুনেছি বাবা যখন ছোট ছিল খুবই কিউট বাচ্চা ছিল আর এ ও সে এসে চটকে দিত, বিস্কুট লজেন্স দিত। একটা বুড়ো লোক ছিল যাকে আমার বাচ্চা বাবা নাম ধরে ডাকত আর সে আমার বাবার দেখা পেলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। বামুনের ছেলেকে প্রণাম করলে পুণ্যি হয়।


আমার এক কাকা আক্ষেপ করে একদিন বলেছিল, সমস্ত রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের নাম আজকাল সোনার চাঁদ সোনার টুকরো। হ্যাঁ সে ট্রেনে যেতে যেতে নজর রাখে স্টেশন মাস্টারের নামফলকের দিকে - পদবী দেখবে বলে।

আশা করছি এতসব স্বীকারোক্তির পরে আমাকে কেউ আর বর্ণহিন্দু বলে গাল পাড়বেন না। পাড়লেও ভারি বয়ে গেছে। কয়েকমাস পরেই আমার তুতো দিদির ছেলের পইতে। তখন কবজি ডুবিয়ে খাব। আর ব্রহ্মচারী দন্ডিঘরে থাকাকালীন তার চোখ যেন কোনও অব্রাহ্মণের দিকে না যায় সেই ব্যবস্থা করব। জয় গুরু!

No comments:

Post a Comment